Duis autem vel eum iriure dolor in hendrerit in vulputate velit esse molestie consequat, vel illum dolore eu feugiat nulla facilisis at vero eros et accumsan et iusto odio dignissim qui blandit praesent luptatum zzril delenit augue duis.
Read More

শুক্রবার, ৪ অক্টোবর, ২০১৯

রাণী না খুনি? (প্রথম অংশ) 





(অর্থাৎ অপরিচিত ব্যক্তিকে বিশ্বাস করিবার চুড়ান্ত ফল!)
Detective STORIES Vol, 80. দারোগার দপ্তর ৮০ম সংখ্যা। 
প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত। 
সিকদারবাগান বান্ধব পুস্তকালয় ও সাধারণ পাঠাগার হইতে বাণীনাথ নন্দী কর্তৃক প্রকাশিত।
All Rights Reserved. 
সপ্তম বর্ষ । সন ১৩০৫ সাল। অগ্রহায়ণ। 
Printed By Shashi Bhusan Chandra, at the GREAT TOWN PRESS, 68, Nimtola Street, Calcutta.

দারোগার দপ্তর।
রাণী না খুনি?

প্রথম পরিচ্ছেদ।

একদিবস সন্ধ্যার সময় আমাদিগের সদর আফিস হইতে কাগজ পত্র আসিবার পর দেখিলাম, অপরাপর কাগজ-পত্রের সহিত একখানি দরখাস্ত আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। সেই দরখাঙ্কের সত্যাসত্যের বিষয় অনুসন্ধান করিবার তার আমার উপর ন্যস্ত আছে। দরখাস্তখানি আমি আদ্যোপান্ত পাঠ করিলাম। দেখি লাম, বড়বাজারের একজন প্রধান জহরত-ব্যবসায়ী এই দরখাস্ত করিতেছেন। সেই দরখাস্তের মৰ্ম্ম এইরূপ–

আজ কয়েকদিবস অতীত হইল, কতকগুলি জহরত খরিদ করিকার নিমিত্ত, একজন রাণী আমাদিগের দোকানে আগমন করিয়াছিলেন। তাঁহার সহিত কালীবাবু নামক একজন লোক ছিল, তিনি জহরতের দালাল, কি রাণীজির লোক, তাহা আমরা অবগত নহি। দালালি করিতে ইতিপূর্বে আমরা কখন তাহাকে দেখি নাই, অথচ রাণীজির সহিত তাহাকে কথা কহিতে শুনি আছি। রাণীজি একখানি গাড়িতে করিয়া আমাদিগের দোকানে আগমন করিয়াছিলেন সত্য; কিন্তু তিনি গাড়ি হইতে অবতরণ করেন নাই, বা আমাদিগের সহিত কোনরূপ কথাবার্তাও কহেন নাই। তাহার যাহা কিছু বলিবার প্রয়োজন হইয়াছিল, তাহার সমভিব্যাহারী সেই কালীবাবুর প্রমুখাৎই তিনি সমস্ত বলিয়াছিলেন। রাণীজি আমাদিগের দোকানে আসিয়া কতকগুলি জহরত খরিদ করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, এবং কতকগুলি জহরতও দেখিতে চাহেন। সেই সকল জহরতের মধ্য হইতে প্রায় দশ হাজার টাকার মূল্যবান্ কয়েকখানি জহরত পসন্দ করিয়া বলিয়া যান, সেই সকল জহরত যেন তাহার বাড়ীতে পাঠাইয়া দেওয়া হয়। সেই স্থানে জহরত লইয়া কোন ব্যক্তি গমন করিলে, তিনি সেই সকল দ্রব্য নগদ মুল্যে গ্রহণ করিবেন, এবং আরও যদি কোন দ্রব্যের প্রয়োজন হয়, এরূপ মনে করেন, তাহাও তাহাকে বলিয়া দিবেন। এই কথা বলিয়া রাণীজি প্রস্থান করেন। কিন্তু তাঁহার সহিত কালীবাবু নামক যে লোকটা আগমন করিয়াছিলেন, তিনি আমাদিগের ললাকে রাণীজির বাড়ীতে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইবার মানসে সেই স্থানেই অপেক্ষা করেন। আমাদিগের দোকানের অতিশয় বিশ্বাসী রামজী লাল নামক যে একজন বহু পুরাতন কৰ্মচারী ছিলেন, তিনি সেই জহরত লইয়া কালীবাবুর সহিত একখানি গাড়িতে প্রস্থান করেন। সেই সময় হইতে আর রামজীলাল প্রত্যাবর্তন করেন নাই, বা জহরত কি তাহার মূল্যও এ পর্যন্ত পাঠাইয়া দেন নাই। আমরা এ পর্যন্ত নানা স্থানে রামজীলালের অনুসন্ধান করিয়াছি, তাঁহার্য দেশে পৰ্য্যন্ত টেলিগ্রাফ করিয়াছি; কিন্তু কোন স্থান হইতেই তাহার কোনরূপ সংবাদ প্রাপ্ত হই নাই। এখন আমরা বুঝিতে পারিতেছি না যে, রামজীলালের ও তাহার নিকটস্থিত সেই বহুমূল্য জহরতগুলির অবস্থা এখন কি হইয়াছে। এই নিমিত্ত এই আবেদনপত্রের দ্বারা সরকারের সাহায্য গ্রহণ করিতেছি, তাঁহারা অনুসন্ধান করিয়া, যাহাতে রামজীলাল ও জহরতগুলির অনুসন্ধান হয়, তাহার চেষ্টা করুন। বলা বাহুল্য, এই অনুসন্ধান করিতে যে সকল খরচ-পত্রের প্রয়োজন হইবে, তাহা আমরা প্রদান করিতে প্রস্তুত আছি।

এই দরখাস্তের অনুসন্ধানের ভার আমার উপর ন্যস্ত হইলে, আমি কিন্তু সেই রাত্রিতে উহার অনুসন্ধানে বহির্গত হইলাম না। পরদিবস হইতে উহার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব, মনে মনে এইরূপ স্থির করিলাম; কিন্তু কালীবাবু ও রামজীলাল সম্বন্ধে নানাপ্রকার তর্ক আসিয়া মনে উপস্থিত হইতে লাগিল।

একবার ভাবিলাম, রামজীলাল নিশ্চয়ই একজন সামান্য বেতনের কৰ্ম্মচারী হইবেন, দশ হাজার টাকা মূল্যের জহরত তাহার হস্তে একবারে পতিত হইয়াছে, এ লোভ সম্বরণ করা তাহার পক্ষে কতদুর সম্ভব? কিন্তু পরক্ষণেই মনে হইল, রামজীলাল যে ধনীর কাৰ্য করিয়া থাকেন, তিনি নিজেই বলিতেছেন যে, রামজীলাল একজন। বহু পুরাতন ও অতি বিশ্বাসী কর্ম্মচারী। যদি তাহার কথা প্রকৃত হয়, তাহা হইলে অনেক সময় তাহার হস্তে যে অনেক অর্থ আসিয়া পড়ে, সে সম্বন্ধে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। এরূপ অবস্থায় এই সকল জহরত বা তাহার মুল্য গ্রহণ করিয়া পলায়ন করা রামজীলালের পক্ষে কতদুর সম্ভব, তাহা স্থির করিয়া উঠা নিতান্ত সহজে নহে।

দ্বিতীয়ত, যে রাণীজি জহরত খরিদ করিতে আগমন করিয়া ছিলেন, তিনিই বা কে? এবং তাঁহার সমভিব্যাহারে কালীবাবু নামক যে ব্যক্তি আগমন করিয়াছিলেন, তিনিই বা কে? রাণীজি যদি প্রকৃতই রাণীজি হইবেন, তাহা হইলে তিনি নিজে বাজারে জহরত খরিদ করিতেই বা আসিবেন কেন? বাড়ীতে বসিয়া সংবাদ পাঠাইলেই ত অনেক বড় বড় জহুরী তাহার নিকট জহরত লইয়া যাইত। আর যদি তিনি নিজেই জহরত খরিদ করিবার মানসে বাজারে আসিলেন, তাহা হইলে কেবলমাত্র এক কালীবাবু ব্যতীত আর কোন ব্যক্তি তাহার সহিত আগমন করিল না কেন? আর কালীবাবু তাহার নিজের লোক, কি বাজারের দালাল, তাহারই বা ঠিকানা কি? কালীবাবু যদি তাহার নিজের লোকই হইবেন, তাহা হইলে তাহাকে দোকানে পরিত্যাগ করিয়া তিনি কেবলমাত্র সহিস-কোচবানের সঙ্গেই বা গমন করিলেন কিরূপে? আর যদি কালীবাবু বাজারের দালালই হইবেন, তাহা হইলে রাণীজি তাহার সহিত বাজারে আসিতে কিরূপে সাহসী হইলেন? এরূপ অবস্থায় ইহার ভিতরের কথা অনুমান করা নিতান্ত সহজ ব্যাপার নহে। তবে রাণীজি যদি কোন রাজবংশীয়া দুশ্চরিত্রা স্ত্রীলোক হন, তাহা হইলে এইরূপ ভাবে অনায়াসেই তিনি বাজারে আদিতে সমর্থ হইবেন; কিন্তু প্রকৃত রাণী এরূপ ভাবে বাজারে আসিতে কখনই সাহসী হইতে পারেন না। আরও এক কথা, রামজীলাল যদি প্রকৃতই জহরতগুলি বিক্রয় করিয়া প্রস্থান করিয়া পাকেন, এবং কালীবাবু যদি তাহার সহিত এই অসৎকার্যে মিলিত না থাকেন, অথচ কালীবাবু যদি প্রকৃতই একজন দালাল হন, তাহা হইলে দালালী লইবার প্রত্যাশায় কালীবাবু সেই জহরতের দোকানে এ পর্যন্ত আর প্রত্যাবর্তন করিলেন না কেন? আবার মনে হইল, আজকাল রাজা বা রাণী সাজিয়া যে সকল ভয়ানক ভয়ানক জুয়াচুরি হইয়া থাকে, ইহা সেই প্রকারের কোন একরূপ জুয়াচুরি নয় ত? যদি তাই হয়, যদি সেইরূপ ভাবে কোনরূপ জুয়াচুরি হইয়া থাকে, তাহা হইলে রামজীলাল কোথায় গমন করিল? ইহার অনুসন্ধানের ভিতর বড়ই গোলযোগ আসিয়া উপস্থিত হইতেছে; এক কথা ভাবিতে গেলে, অপর আর একটা কথা মনে আসিয়া সমস্ত চিন্তাকেই সন্দেহে পরিণত করিয়া দিতেছে। এ সম্বন্ধে আর কোন কথা ভাবিব না, কল্য প্রাতঃ কাল হইতে ইহার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব। অনুসন্ধানে যে সকল বিষয় অবগত হইতে পারিব, তখন তাহার উপর নির্ভর করিয়া সবিশেষরূপ বিবেচনা করিয়া দেখিব, এই অনুসন্ধান আমার দ্বারা সুচারুরূপে সম্পন্ন হইতে পারে কি না। যদি কৃতকার্য হইব মনে করি, তাহা হইলে ইহাতে সম্পূর্ণরূপে হস্তক্ষেপ করিব। নতুবা উৰ্দ্ধতন কর্ম্মচারীগণকে বলিয়া, এই অনুসন্ধানের ভার অপরের  হস্তে প্রদান করিব। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সেই রাত্রিতে এ সম্বন্ধে আর কোন বিষয় চিন্তা করিব না, ইহা স্থির করিলাম; কিন্তু কাৰ্য্যে তাহা পরিণত করিতে পারিলাম না।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

পরদিবস প্রত্যূষেই আমি এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে বহির্গত হইলাম। থানা হইতে বহির্গত হইয়া, প্রথমেই দরখাস্তকারী জহরত-ব্যবসায়ীর দোকানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। যে সময় আমি দোকানে গিয়া উপস্থিত হইলাম, সেই সময় যাহার দোকান, তিনি দোকানে উপস্থিত ছিলেন না। কয়েকজন কর্ম্মচারী কেবল মাত্র দোকানে উপস্থিত ছিলেন। আমি কে, এবং কি নিমিত্ত সেই স্থানে গমন করিয়াছি, তাহা অবগত হইবার পর, দোকানের একজন কর্ম্মচারী আমাকে সঙ্গে করিয়া সেই দোকানের স্বত্বাধি কারীর নিকট লইয়া গেলেন। সেই সময় তিনি আপনার বাড়ীতে উপস্থিত ছিলেন। আমার পরিচয় ও সেই স্থানে আমার গমনের কারণ অবগত হইয়া, সবিশেষ যত্নের সহিত তিনি আমাকে বসা ইলেন, এবং তাহার দোকানের যে কর্ম্মচারী আমার সহিত সেই স্থানে গমন করিয়াছিলেন, তাঁহাকে তাঁহার দোকানে প্রত্যাবর্তন করিতে কহিলেন। আদেশমাত্র কর্ম্মচারী সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। কর্ম্মচারী প্রস্থান করিবার পর, তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, যে কাৰ্য্যের নিমিত্ত আমি দরখাস্ত করিয়াছিলাম, সেই কাৰ্যের অনুসন্ধানের ভার কি আপনার উপর অর্পিত হইয়াছে?

আমি। তাহারই অনুসন্ধান করিবার মানসে আমি এই স্থানে আগমন করিয়াছি।

ধনী। আমি যে সকল কথা দরখাস্তে লিখিয়াছি, তাহা আপনি উত্তমরূপে পড়িয়া দেখিয়াছেন কি?

আমি। আমি উহা বেশ করিয়া পড়িয়া দেখিয়াছি, এবং বরখাস্তখানি আমার সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি।

এই বলিয়া আমার পকেট হইতে সেই দরখাস্তখানি বাহির করিয়া, আমার সম্মুখে রাখিয়া দিলাম, এবং তাঁহাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনি দরখাস্তে যে সকল বিষয় লিখিয়াছেন,

তদ্ব্যতীত আর কোন কথা আমাকে বলিতে চাহেন কি?

ধনী। যাহা কিছু আমার বলিবার, তাহা আমি এই দরখাস্তে ব্যক্ত করিয়াছি। তদ্ব্যতীত আর কোন বিষয় যদি আপনি অবগত হইতে চাহেন, তাহা আমাকে জিজ্ঞাসা করুন, আমি যতদূর জানি, তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান করিতে প্রস্তুত আছি।

আমি। যে সময় রাণীজি জহরত খরিদ করিবার মানসে কালী বাবুর সমভিব্যাহারে আপনার দোকানে আগমন করিয়াছিলেন, সেই সময় আপনি নিজে বোধ হয়, দোকানে উপস্থিত ছিলেন না?

ধনী। সেই সময় আমি নিজে দোকানে উপস্থিত ছিলাম। যাহা কিছু হইয়াছিল, তাহার সমস্তই আমার সম্মুখে হইয়াছিল।

আমি। রাণীজিকে কি আপনি দেখিয়াছিলেন?

ধনী। তাহাকে আমরা কেহই দর্শন করি নাই। তিনি গাড়ির ভিতরে ছিলেন, গাড়ি হইতে তিনি বহির্গত হন নাই, বা গাড়ির আবরণও উন্মুক্ত করা হয় নাই।

আমি। যে গাড়ির ভিতর রাণীজি ছিলেন বলিতেছেন, সেই গাড়ির ভিতর কোন লোক যে ছিল, তাহা আপনারা কোনরূপে ভাল করিয়া বুঝিতে পারিয়াছিলেন কি?

ধনী। গাড়ির ভিতর যে লোক ছিল, সে বিষয়ে আর কিছু মাত্র সন্দেহ নাই। যদিও আমরা তাহাকে স্পষ্ট দেখি নাই; কিন্তু তাহার পরিহিত বস্ত্রাদির কিয়দংশ মধ্যে মধ্যে আমরা দেখিয়াছিলাম, এবং তাঁহার বেশ স্পষ্ট স্পষ্ট কথাও আমরা শুনিতে পাইয়াছিলাম।

আমি। আপনারা তাহার কথা শুনিয়া, তাহাকে স্ত্রীলোক বলিয়াই অনুমান করিয়াছিলেন?

ধনী। তিনি যে স্ত্রীলোক, তদ্বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।

আমি। তাহার কথা শুনিয়া তাহাকে কোন্ দেশীয় স্ত্রীলোক বলিয়া অনুমান হয়?

ধনী। তাহা আমরা স্থির করিতে পারি নাই। কারণ, তাহার সমভিব্যাহারী সেই কালীবাবুর সহিত যখন তিনি কথা বলিয়াছিলেন, তখন বাঙ্গালা কথাই বলিয়াছিলেন; কিন্তু আমরা তাহাকে যে দুই একটা কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, তাহার উত্তরে, এবং মধ্যে মধ্যে আমাদিগকে যে দুই একটী অপর কোন জহরত দেখাইতে বলিয়াছিলেন, তাহা হিন্দী ভাষায় বলিয়াছিলেন। কিন্তু সে হিন্দী বেশ পরিষ্কার হিন্দী নহে, যেন বাঙ্গালার সহিত মিশ্রিত বলিয়া আমার অনুমান হইয়াছিল।

আমি। রাণীজি যে গাড়িতে ছিলেন, সেই গাড়ির ভিতর অপর আর কেহ ছিল?

ধনী। তাহা আমরা বুঝিতে পারি নাই। সেই গাড়ির ভিতর অপর আর কাহাকেও দেখি নাই, বা অপর আর কোন ব্যক্তির কোনরূপ কথাও শুনিতে পাই নাই।

আমি। তিনি কোন স্থানের রাণী, তাহা কিছু আপনাকে বলিয়াছিলেন কি?

ধনী। তিনি আমাকে বলেন নাই; কিন্তু কালীবাবু বলিয়া ছিলেন। যে স্থানের নাম তিনি উল্লেখ করিয়াছিলেন, তাহা আমায় মনে নাই, সেই স্থানের নাম ইতিপূৰ্বে আর কখনও শুনি নাই। সেই নামটী মনে করিবার নিমিত্ত সবিশেষরূপ চেষ্টাও করিয়াছি। কিন্তু কিছুতেই মনে করিয়া উঠিতে পারি নাই।

আমি। রাণীজি যে গাড়িতে আগমন করিয়াছিলেন, কালী বাবুও কি সেই গাড়িতে আসিয়াছিলেন?

ধনী। না, রাণীজি একখানি জুড়িগাড়িতে আসিয়াছিলেন। কালীবাবু আসিয়াছিলেন-একখানি কম্পাস গাড়িতে।

আমি। উহা কি ঘরের গাড়ি বলিয়া অনুমান হয়?

ধনী। না, আমার বোধ হয়, উহা ঘরের গাড়ি নয়; আড়গোড়ার গাড়ি।

আমি। আপনি কিরূপে জানিতে পারিলেন যে, উহা আড়গোড়ার গাড়ি?

ধনী। সেই গাড়ির সহিস-কোচবানের পোষাক ও পরিচ্ছদ দেখিয়া আমার বেশ অনুমান হইতেছে যে, সেই গাড়ি নিশ্চয়ই কোন এক আড়গোড়ার।

আমি। দুইখানি গাড়িই কি আড়গোড়ার গাড়ি বলিয়া অনু মান হয়?

ধনী। দুইখানিই এক আড়গোড়ার গাড়ি। দুইখানি গাড়ির সহিস-কোচবানদিগের পোষাক-পরিচ্ছদ একই প্রকারের।

আমি। রামজীলাল আপনার কে?

ধনী। রামজীলাল সম্পর্কে আমার কেহই হন না; কিন্তু তিনি আমার জহরতের দোকানের সর্বপ্রধান কর্ম্মচারী।

আমি। কতদিবস হইতে তিনি আপনার দোকানে কল্প করিতেছেন?

ধনী। রামজীলাল আমার একজন বহু পুরাতন কর্ম্মচারী; প্রায় ত্রিশ বৎসর তিনি আমার দোকানে কৰ্ম্ম করিতেছেন।

আমি। তাঁহার স্বভাব-চরিত্র কিরূপ?

ধনী। তাঁহার স্বভাব-চরিত্রও যেরূপ ভাল, তিনি বিশ্বাসীও সেইরূপ। আমার বোধ হয়, আমি আমাকে যতদূর বিশ্বাস করিতে না পারি, তাহা অপেক্ষা অধিক তাহাকে বিশ্বাস করিতে পারি। আমার দোকানের লক্ষ লক্ষ টাকার দ্রব্যাদি সমস্তই তাহার হস্তে, তিনি মনে করিলে ইহার সমস্তই অনায়াসেই আত্মসাৎ করিতে পারেন। কিন্তু তিনি এতদূর বিশ্বাসী যে, আজ পর্যন্ত একটা পয়সাও তাঁহা কর্তৃক অপহৃত হয় নাই।

আমি। রামজীলাল যদি আপনার এতদূর বিশ্বাসী কর্ম্মচারী, তাহা হইলে সেই দশ হাজার টাকার জহরত লইয়া তিনি কিরূপে প্রস্থান করিলেন?

ধনী। রামজীলাল যে সেই জহরত লইয়া পলায়ন করিয়া ছেন, তাহা কখনই সম্ভব হইতে পারে না। এরূপ কথা আমি কোনরূপেই বিশ্বাস করিতে পারি না।

আমি। তবে রামজীলাল কোথায় গমন করিলেন?

ধনী। আমিও তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। আমার বোধ হয়, রামজীলাল কোনরূপে বিপদগ্রস্ত হইয়াছেন বলিয়া প্রত্যাবর্তন করিতে পারিতেছেন না।

আমি। সে যাহা হউক, রামজীলাল যে সকল জহরত লইয়া গিয়াছেন, তাহার কোনরূপ তালিকা প্রস্তুত করিয়াছেন কি?

ধনী। না, তাহা করি নাই। যদি আবশ্যক হয়, তাহা হইলে এখনই আমি উহা প্রস্তুত করিয়া দিতে পারি।

আমি। তাহা হইলে অনুগ্রহপূর্বক একটী সবিশেষ বিবরণ যুক্ত তালিকা প্রস্তুত করিয়া এখনই আমাকে প্রদান করুন।

আমার কথা শুনিয়া তৎক্ষণাৎ জহরতগুলির সবিশেষ বিবরণ যুক্ত একটা তালিকা প্রস্তুত করিয়া কর্ম্মচারী আমার হস্তে প্রদান করিলেন। আমি সেই তালিকা আপন হস্তে গ্রহণ করিয়া পুনরায় তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, আচ্ছা, সেই সকল জহরত যদি অপরাপর জহরতের সহিত একত্র পুনরায় আপনাকে দেখাই, তাহা হইলে চিনিতে পারিবেন ত?

ধনী। জহরতগুলি যেরূপ অবস্থায় আমার এই স্থান হইতে লইয়া গিয়াছে, সেইরূপ অবস্থায় যদি উহা না থাকে, তাহা হইলে উহার প্রত্যেক পাথরের মতি প্রভৃতি পৃথক পৃথক অবস্থায় অপর প্রস্তর প্রভৃতির সহিত মিশ্রিত করিয়া আমার সম্মুখে আনিবেন, দেখিবেন, আমার দ্রব্য আমি তাহার ভিতর হইতে অনায়াসেই বাছিয়া লইতে সমর্থ হইব।

জহরত-বিক্রেতার নিকট হইতে এই সকল বিষয় অবগত হইয়া সেইদিবস আমি তাহার নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলাম। সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার সময় আমার মনে হইল, দোকানদার রামজীলালের চরিত্র সম্বন্ধে যেরূপ ভাবে বর্ণন করিলেন, তাহাতে রামজীলালের উপর এই সকল জহরত অপহরণ করা সম্বন্ধে কিরূপে সন্দেহ করিতে পারি? যে ব্যক্তি লক্ষ লক্ষ টাকা লইয়া আপন ইচ্ছানুযায়ী সমস্ত কাৰ্য্যের বন্দোবস্ত করেন, অথচ যাহার কার্যের নিমিত্ত মনিব কখনও একবারেরও নিমিত্ত দৃষ্টিপাত করেন না, সেই ব্যক্তি কেবলমাত্র যে দশ হাজার টাকা মূল্যের জহরত লইয়া পলায়ন করিবে, তাহা কিন্তু সহজে মনে স্থান দিতে পারা যায় না।

যাহা হউক, দোকানদারের নিকট হইতে এই সকল বিষয় অবগত হইয়া আমি থানায় প্রত্যাবর্তন করিলাম। ভাবিলাম, একটু পরেই পুনরায় এই অনুসন্ধানে বহির্গত হইয়া যাইব; কিন্তু কার্যে তাহা ঘটিল না। সেই সময় কোন একটী সবিশেষ প্রয়োজনীয় রাজ্য-সম্বন্ধীয় সরকারী কাৰ্য আসিয়া আমার হস্তে উপস্থিত হইল। সুতরাং বর্তমান কার্যের অনুসন্ধান সেই সময় আমাকে পরিত্যাগ করিতে হইল। আমি সেই কাৰ্য্যের অনুসন্ধান সেই সময় পরিত্যাগ করিলাম সত্য; কিন্তু সেই অনুসন্ধান একবারে বন্ধ হইল না। অপর আর একজন কর্ম্মচারীর হস্তে এই অনুসন্ধানের ভার অর্পণ করিয়া, যতদূর আমি জানিতে পারিয়াছিলাম, তাহার সমস্ত বিবরণ আমি তাহাকে বুঝাইয়া দিলাম। তিনি তাহার অনুসন্ধানের নিমিত্ত বহির্গত হইলেন, আমিও সেই সবিশেষ প্রয়োজনীয় সরকারী কার্যের অনুসন্ধানে বহির্গত হইবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইতে লাগিলাম।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

গবর্ণমেন্টের যে কাৰ্য্য সম্বন্ধে আমাকে নিযুক্ত হইতে হইয়াছিল, সেই কাৰ্য শেষ করিতে আমার প্রায় দুই তিনদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। সেই কাৰ্য্য সমাপনান্তে আমি থানায় প্রত্যাবর্তন করিয়া, যে কর্ম্মচারীর হস্তে রামজীলাল সম্বন্ধীয় অনুসন্ধানের ভার অৰ্পণ করিয়া গিয়াছিলাম, তাহাকে ডাকিলাম। ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, আমি যে কাৰ্য্যের ভার আপনার হস্তে অৰ্পণ করিয়া গিয়াছিলাম, সেই কাৰ্য্য আপনি কতদূর সম্পন্ন করিতে সমর্থ হইয়াছেন?

কর্ম্মচারী। অনুসন্ধান প্রায় আমি একরূপ শেষই করিয়া রাখিয়াছি, এখন আসামীকে ধরিতে পারিলেই হইল।

আমি। আসামী কে?

কর্ম্মচারী। রামজীলাল।

আমি। তার অপরাধ?

কর্ম্মচারী। অপরাধ, তাহার মনিবের টাকা আত্মসাৎ করা।

আমি। তাহা হইলে ইহাই সাব্যস্ত হইয়াছে যে, রামজীলাল সেই সকল জহরত লইয়া পলায়ন করিয়াছে?

কর্ম্মচারী। না, সেই সকল জহরত লইয়া রামজীলাল পলায়ন করে নাই। সেই সকল জহরত বিক্রয় করিয়া তাহার মূল্য লইয়া রামজীলাল পলায়ন করিয়াছে।

আমি। এ সম্বন্ধে বেশ প্রমাণ পাইয়াছেন?

কর্ম্মচারী। তাহার বিপক্ষে বেশ প্রমাণ আছে; মাজিষ্ট্রেট সাহেবও তাহার কতক প্রমাণ গ্রহণ করিয়া রামজীলালের নামে

ওয়ারেন্ট বাহির করিয়া দিয়াছেন।

আমি। ভালই হইয়াছে। সেই ওয়ারেন্ট এখন কোথায়?

কর্ম্মচারী। আমার নিকটেই আছে।

আমি। সেই ওয়ারেন্ট আমাকে প্রদান করিবেন। তাহাকে ধরিবার নিমিত্ত আমি একবার চেষ্টা করিয়া দেখিব; আপনিও আপনার চেষ্টার ত্রুটি করিবেন না।

কর্ম্মচারী। সেই ওয়ারেন্টখানি এখনই আমি আপনাকে প্রদান করিব কি?

আমি। এখনই আমাকে প্রদান করিতে হইবে না; কিন্তু আপনি কিরূপ অনুসন্ধান করিয়াছেন, এবং রামজীলালের বিপক্ষে কিরূপ প্রমাণ সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা আমি পূর্বে একবার জানিতে ইচ্ছা করি।

কর্ম্মচারী। উত্তম কথা। আমি যাহা যাহা করিয়াছি, তাহা আপনাকে বলিতেছি। আমি প্রথমতঃ কালীবাবুর নিকট সমস্ত কথা শুনিয়া তাহার পর অপরাপর লোকের নিকট অনুসন্ধান করি।

আমি। কালীবাবুর সন্ধান করিয়া, তাহাকে কিরূপে বাহির করিতে সমর্থ হইলেন?

কর্ম্মচারী। কালীবাবুর অনুসন্ধান করিতে আমার কিছুমাত্র কষ্ট হয় নাই। আমি প্রথমতঃ দরখাস্তকারীর দোকানে গমন করি। কালীবাবুকে দেখিলে চিনিতে পারিবে, এইরূপ একটী লোক সঙ্গে করিয়া কালীবাবুর অনুসন্ধান করিবার মানসে, সেই স্থান হইতে আসিতেছিলাম, সেই সময় পথিমধ্যে হঠাৎ কালীবাবুকে দেখিতে পাইয়া সেই ব্যক্তি আমাকে দেখাইয়া দেয়।

আমি। কালীবাবু কি কাৰ্য্য করিয়া থাকেন?

কর্ম্মচারী। তাহা আমি জানি না, জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিয়াছিলেন যে, তিনি দালালী কাৰ্য্য করিয়া থাকেন।

আমি। কালীবাবু প্রকৃতই দালালী কাৰ্য্য করেন কি না, সে সম্বন্ধে আপনি কোনরূপ অনুসন্ধান করিয়াছেন কি?

কর্ম্মচারী। না।

আমি। তিনি থাকেন কোথায়?

কর্ম্মচারী। তিনি যেখানে থাকেন, তাহা আমি জানি; আমি নিজে গিয়া তাঁহার বাড়ী দেখিয়া আসিয়াছি।

আমি। কিরূপ বাড়ীতে তিনি থাকেন?

কর্ম্মচারী। দোতালা পাকা বাড়ী।

আমি। তিনি সেই বাড়ীতে একাকী বাস করিয়া থাকেন কি?

কর্ম্মচারী। না, সেই বাড়ীতে অনেকগুলি স্ত্রীলোক থাকে, তাহাদিগের মধ্যে একখানি ঘরে তিনিও বাস করেন।

আমি। সেই স্ত্রীলোক কি প্রকারের, গৃহস্থ, না বেশ্যা?

কৰ্ম্মচারী। বেশ্যা।

আমি। তাহা হইলে যে গৃহে কালীবাবু থাকেন, সেই গৃহেও বোধ হয়, একজন বেশ্যা বাস করিয়া থাকে?

কর্ম্মচারী। হাঁ, একটী বেশ্যাকে লইয়া কালীবাবু সেই বার্সীতেই থাকেন।

আমি। কালীবাবুর সহিত আপনার সাক্ষাৎ হইলে তিনি আপনাকে কি বলিলেন?

কর্ম্মচারী। আমি তাঁহাকে দেখিয়াই তাহাকে একবারে জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনি রামজীলাল নামক এক ব্যক্তির মারফত যে সকল জহরত আনিয়াছিলেন, তাহা এখন আপনার নিকট আছে, কি বিক্রয় করিয়া ফেলিয়াছেন? উত্তরে তিনি কহিলেন, যাহার নিমিত্ত সেই সকল জহরত আনা হইয়াছিল, তিনি তৎক্ষণাৎ সেই সকল জহরত গ্রহণ করিয়াছেন, এবং সেই প্রেরিত লোক মারফত সমস্ত টাকাও প্রদান করিয়াছেন। টাকা লইয়া রামজীলাল তৎক্ষণাৎ সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিয়াছেন। সেই সকল জহরত বিক্রয় করিয়া আমার ন্যায্য যে কিছু দালালী প্রাপ্য হয়, তাহার কিয়দংশ তিনি আমাকে প্রদান করিয়া গিয়াছেন, এবং বলিয়া গিয়াছেন, দুই একদিবসের মধ্যে আরও কতকগুলি জহরত লইয়া তিনি আসিবেন, সেই সময় আমার দালালীর অবশিষ্ট যাহা প্রাপ্য আছে, তাহা প্রদান করিয়া যাইবেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত তিনি আর প্রত্যাবর্তন করিলেন না, বা আমার ন্যায্য পাওনাগুলিও পাঠাইয়া দিলেন না; আমিও নানা ঝঞ্চাটে আর সেই দোকানে গমন করিতে পারি নাই।

আমি। আপনি কালীবাবুকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন কি যে, সেই সকল জহরত কালীবাবু নিজে খরিদ করিয়াছিলেন, কি অপর কোন লোক খরিদ করিয়াছিল?

কর্ম্মচারী। জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। উত্তরে কালীবাবু আমাকে এই বলিয়াছিলেন যে, রাজার মত কোন একজন জমিদার সেই জহরত খরিদ করিয়াছেন।

আমি। সেই রাজা বা জমিদার কে?

কর্ম্মচারী। কালীবাবু তাহা আমাকে বলেন নাই।

আমি। তিনি যে বাড়ীতে থাকেন, সেই বাড়ী আপনাকে দেখাইয়া দিয়াছিলেন কি?

কর্ম্মচারী। না, তাঁহার বাড়ীও আমাকে দেখাইয়া দেন নাই।

আমি। তাহা হইলে জহরতগুলি কোন্ স্থানে তিনি গ্রহণ করেন, এবং উহার মূল্যই বা কোন্ স্থানে তিনি প্রদান করেন?

কর্ম্মচারী। কালীবাবু আমাকে কেবল ইহাই বলেন যে, যে বাড়ীতে কালীবাবু থাকেন, সেই বাড়ীর কোন একটী স্ত্রীলোকের গৃহে সেই জমিদার মহাশয় আগমন করিতেন। সেই স্থানে কালী বাবুর সহিত তাহার পরিচ হয়, এবং কতকগুলি জহরত আনিবার নিমিত্ত সেই স্থানে বসিয়াই কালীবাবুকে আদেশ করেন। তাঁহারই আদেশ মত কতকগুলি জহরত আনা হয়। সেই সকল জহরতের সঙ্গে রামজীলাল আগমন করেন, এবং সেই স্ত্রীলোকের গৃহে বসিয়াই তিনি সেই সকল জহরত খরিদ করেন, ও রামজীলালের হস্তে উহার মূল্য প্রদান করেন।

আমি। একজন রাণী যে জহরত খরিদ করিতে গিয়াছিলেন, তাহা হইলে সেই রাণী কে?

কর্ম্মচারী। রাণী যে কে, তাহা কালীবাবু আমাকে স্পষ্ট করিয়া বলেন নাই। কেবল তিনি আমাকে এইমাত্র বলিয়াছিলেন, যে স্ত্রীলোকটার গৃহে তিনি আগমন করিতেন, সেই স্ত্রীলোকটীকে সঙ্গে লইয়া তিনি জহরত খরিদ করিতে বাজারে গমন করেন। তিনি যে জুড়িতে ছিলেন, সেই স্ত্রীলোকটীও সেই জুড়িতে ছিলেন বলিয়া, লাক-লজ্জার ভয়ে তিনি গাড়ির ঘেরাটোপ ফেলিয়া সেই স্ত্রী লোকটীর সহিত বাজারে আগমন করেন। তাঁহার ইচ্ছা ছিল, তিনি নিজে দোকানে বসিয়া জহরতগুলি দেখিয়া শুনিয়া পসন্দ করিয়া লইবেন; কিন্তু দোকানে গমন করিয়া, গাড়ি হইতে বাহির হইবার সময় দেখিতে পান, সেই দোকানে একটী লোক বসিয়া আছেন। বোজ হয়, সেই লোকটীই সেই দোকানের মালিক। সেই লোকটীকে তিনি পূর্ব হইতে চিনিতেন। কারণ, সেই ব্যক্তির সহিত তাঁহার পিতার সবিশেষরূপ পরিচয় আছে। তিনি পাছে তাহার চরিত্রের কথা তাঁহার পিতার নিকট বলিয়া দেন, এই ভয়ে তিনি আর গাড়ি হইতে নামিতে সাহসী হন নাই, এবং সেই স্থানে আত্মপ্রকাশ হইয়া পড়িবে, এই ভয়ে সেই স্ত্রীলোকটীকে রাণী বলিয়া পরিচয় প্রদান করিতে কালীবাবুকে বলিয়া দেন, ও তাহাকেই জহরতগুলি দেখা ইয়া খরিদ করিতে বলেন। কালীবাবু, নামে জহরতগুলি রাণীজিকে দেখান; কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সেই জমিদার-পুত্রই সেই গাড়ির ভিতর হইতে জহরতগুলি দেখিয়া পসন্দ করেন, এবং পুনরায় ভাল করিয়া দেখিয়া উহার মূল্য প্রদান করিবেন, বিবেচনা করিয়া, জহরতগুলি কালীবাবুর বাসায় লইয়া যাইবার নিমিত্ত কালীবাবুকে সেই স্থানে রাখিয়া তাঁহারা প্রস্থান করেন। কালীবাবু সেই সকল জহরত রামজীলালের মারফত তাহার বাড়ীতে লইয়া যান। সেই স্থানে জমিদার-পুত্র পুনরায় জহরতগুলি ভাল করিয়া দেখেন, এবং পরিশেষে রামজীলালের হস্তে উহার মূল্য প্রদান করিয়া জহরতগুলি গ্রহণ করেন।

আমি। কালীবাবু যে সকল কথা বলেন, তাহাদের পোষকতায় আর কোন প্রমাণ পাইয়াছিলেন কি?

কর্ম্মচারী। পাইয়াছিলাম।

আমি। কি?

কর্ম্মচারী। যাহার গৃহে বসিয়া সেই সকল জহরত গ্রহণ করা হয়, এবং তাহার মূল্য প্রদান করা হয়, সেই স্ত্রীলোকটীও ঠিক সেই কথাই বলে।

আমি। সেই স্ত্রীলোকটী কে?

কর্ম্মচারী। কালীবাবু যে গৃহে থাকেন, সেই স্ত্রীলোকটীও সেই গৃহে থাকে।

আমি। তাহা হইলে কালীবাবু যে স্ত্রীলোকটীর গৃহে থাকেন, সেই স্ত্রীলোকটীই কালীবাবুর কথার পোষকতা করিতেছে?

কর্ম্মচারী।

আমি। রাণীজিও বোধ হয়, তিনিই হইয়াছিলেন?

কর্ম্মচারী। হাঁ।

আমি। সেই স্ত্রীলোকটীর নাম কি?

কর্ম্মচারী। তাহার নাম ত্রৈলোক্য।

আমি। বাড়ীর অপরাপর ভাড়াটিয়াগণ কি বলে?

কর্ম্মচারী। তাঁহারা সবিশেষ কিছুই বলিতে পারে না। তাঁহারা কেবল এইমাত্র বলে যে, কাহার গৃহে কে আসিতেছে, কে যাইতেছে, তাহার খবর কে রাখে? বিশেষতঃ এরূপ সংবাদ রাখা তাহাদিগের নীতি-বিরুদ্ধ।

আমি। পশ্চিমদেশীয় একটী লোক যে সেই বাড়ীতে কতক গুলি জহরত লইয়া গমন করিয়াছিল, তাহা কেহ বলে?

কর্ম্মচারী। সবিশেষ কিছু বলিতে পারে না, তবে এইমাত্র বলে যে, কালীবাবুর সহিত সময় সময় বঙ্গদেশীয়, পশ্চিমদেশীয় প্রভৃতি অনেক লোক প্রায়ই তাঁহার গৃহে আসিয়া থাকে, এরূপ তাঁহারা দেখিতে পায়।

আমি। কত টাকার জহরত খরিদ করা হয়?

কর্ম্মচারী। কালীবাবু কহেন, দশ হাজার টাকায় সেই সকল জহরত খরিদ করা হইয়াছিল।

আমি। টাকাগুলি কিরূপ অবস্থায় রামজীলালকে প্রদান করা হয়,নগদ টাকা দেওয়া হয়, না নোট দেওয়া হয়?

কর্ম্মচারী। সমস্তই নোট, নয়খানি হাজার টাকার হিসাবে নয় হাজার, এবং একশতখানি দশ টাকা হিসাবে এক হাজার টাকা।

আমি। সেই হাজার টাকা হিসাবের নোটগুলির নম্বর পাই বার কোনরূপ উপায় আছে কি?

কর্ম্মচারী। সমস্ত নম্বরই আমি পাইয়াছি।

আমি। কিরূপে সেই সকল নোটের নম্বর পাইলেন?

কর্ম্মচারী। কালীবাবুর নিকট হইতে। যে সময় নোটগুলি রামজীলালকে দেওয়া হয়, সেই সময় কালীবাবু সেই সকল নোটের নম্বর টুকিয়া রাখিয়াছিলেন। তিনি আমাকে সেই সকল নম্বর

প্রদান করিয়াছেন।

আমি। সেই নোটগুলি সম্বন্ধে করেনসি আফিসে একবার অনুসন্ধান করা উচিত।

কৰ্ম্মচারী। সে অনুসন্ধানও আমি করিয়াছি। সেই সকল নোটের টাকা দেওয়া স্থগিত (Stop) করিবার মানসে করেসি আফিসের বড় সাহেবের নামে একখানি পত্র লেখা হয়। সেই পত্রের জবাবে তিনি যাহা বলিয়াছেন, তাহাতেই রামজীলালের উপর আরও সবিশেষরূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে।

আমি। পত্রের উত্তরে তিনি কি লিখিয়াছেন?

কর্ম্মচারী। তিনি লিখিয়াছেন যে, সমস্ত নোটগুলিই রামজী লাল নামক এক ব্যক্তি সেই স্থানে প্রদান করিয়া তাহার পরিবর্তে দশ টাকার হিসাবে নোট বাহির করিয়া লইয়া গিয়াছে।

আমি। এটী সবিশেষ সন্দেহের কথা?

কর্ম্মচারী। এই সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া তাহার নামে ওয়ারেন্ট বাহির করিয়াছি।

আমি। সেই জমিদার-পুত্ৰটী কে, তাহার কিছু অবগত হইতে পারিয়াছেন কি?

কর্ম্মচারী। তাহা আমি এ পর্যন্ত কিছুই জানিতে পারি নাই। কালীবাবু কোনরূপেই তাহার নাম বলিতে সম্মত নহেন, বা তাঁহার বাড়ী দেখাইয়া দিতে বলায়, তিনি বলেন যে, কোথায় যে তাহার বাড়ী, তাহা তিনি অবগত নহেন। বাড়ীর ঠিকানা তিনি কখনও কাহারও নিকট প্রকাশ করেন নাই, নামও বলেন নাই; রাজাসাহেব বলিয়াই সকলে তাহাকে ডাকিয়া থাকেন।

আমি। জহরত খরিদ করিবার পর, রাজাসাহেব ত্রৈলোক্যের গৃহে আর আগমন করিয়াছিলেন কি?

কর্ম্মচারী। তাহার পর দুই একদিবস আসিয়াছিলেন মাত্র; কিন্তু আজ কয়েকদিবস পর্যন্ত আর তিনি সেই স্থানে আগমন করেন নাই।

আমি। কেন আসেন নাই, সেই সম্বন্ধে কেহ কোন কথা বলিতে পারে না কি?

কর্ম্মচারী। ত্রৈলোক্য ও কালীবাবু ইহাই বলেন যে, রাজা সাহেব শেষদিবস যখন সেই স্থানে আগমন করিয়াছিলেন, সেই সময় তিনি বলিয়া যান যে, কোন সবিশেষ কাৰ্য্য উপলক্ষে তাহাকে তাহার দেশে গমন করিতে হইতেছে। বোধ হয়, সেই স্থানে তাহাকে মাসাবধি অবস্থান করিতে হইবে। সুতরাং এক মাসের মধ্যে তিনি আর এখানে আগমন করিবেন না।

আমি। রামজীলাল সম্বন্ধে আপনি কি অনুসন্ধান করিয়াছেন?

কৰ্ম্মচারী। সবিশেষ কোনরূপ অনুসন্ধান করিয়া উঠিতে পারি নাই। কেবল কলিকাতার ভিতর যে যে স্থানে তাহার দেশের লোক বা আত্মীয়-স্বজন আছে, কেবল তাহারই কোন কোন স্থানে রামজীলালের অনুসন্ধান করিয়াছি মাত্র; কিন্তু এখন পর্যন্ত সকল স্থানে গমন করিতে পারি নাই। আমার বোধ হয়, রামজীলাল কলিকাতায় নাই। কারণ, কোন দিক হইতে তাহার কোনরূপ সন্ধান পাওয়া যাইতেছে না। আমার বোধ হয়, সে কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া স্থানান্তরে প্রস্থান করিয়াছে।

আমি। নিতান্ত অসম্ভব নহে; কিন্তু রামজীলাল তাহার মনিবের এতদুর বিশ্বাসপাত্র হইয়া এরূপ অবিশ্বাসের কাৰ্য্য করিবে? যাহা হউক, এ বিষয় একবার উত্তমরূপে দেখা আবশ্যক। অর্থের লোভে সময় সময় মনুষ্যগণ যে কি না করিতে পারে, তাহা বলা সহজ নহে। অর্থই যে অনর্থের মূল তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।

কর্ম্মচারী। এখন এ সম্বন্ধে আমাকে আর কিছু করিতে হইবে কি?

আমি। হইবে বৈকি?

কর্ম্মচারী। কি?

আমি। রামজীলালকে সবিশেষরূপে অনুসন্ধান করিয়া তাহাকে ধরিতে হইবে।

কর্ম্মচারী। আর কিছু?

আমি। সেই জমিদার-পুত্র যে কে, অনুসন্ধান করিয়া তাহার ঠিকানা করিতে হইবে।

কর্ম্মচারী। এই সকল বিষয় অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমি এখন প্রস্তুত হইতে পারি কি?

আমি। এই সকল বিষয়ের অনুসন্ধানের নিমিত্ত আপনি এখন যে স্থানে ইচ্ছা সেই স্থানে গমন করিতে পারেন। কিন্তু আপনি বহির্গত হইয়া যাইবার পূর্বে আর একটা কাৰ্য্য আপনাকে করিতে হইবে।

কর্ম্মচারী। কি?

আমি। আমার সহিত কালীবাবুর বাড়ীতে একবার গমন করিয়া কালীবাবু ও ত্রৈলোক্যকে আমাকে দেখাইয়া দিতে হইবে। কারণ, তাঁহারা যে কে, এবং কি চরিত্রের পোক, সেই সম্বন্ধে আমি সময় মত একবার উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়া দেখি; এবং সেই বাড়ীর অপর ভাড়াটিয়াগণের মধ্যে যদি কেহ সেই জমিদার-পুত্রের কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারেন, তাহারও সবিশেষরূপ চেষ্টা করিয়া দেখিব।

আমার কথায় কর্ম্মচারী মহাশয় সম্মত হইলেন। আমার অবকাশ মত তিনি আমার সহিত গমন করিয়া, কালীবাবু ও তাহার উপপত্নী ত্রৈলোক্যকে আমাকে দেখাইয়া দিবেন, ইহাই স্থিরীকৃত হইল।

আমি অতিশয় ক্লান্ত ছিলাম; সুতরাং সেই দিবসেই আমি আর কালীবাবুর বাড়ীতে গমন করিতে পারিলাম না।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

পরদিবস অতি প্রত্যূষে সেই কর্ম্মচারীকে সঙ্গে করিয়া আমি কালীবাবুর বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। কালীবাবু এবং ত্রৈলোক্য উভয়েই সেই সময় তাহাদিগের গৃহে উপস্থিত ছিল। কালীবাবু আমাকে দেখিয়া, সম্পূর্ণরূপে চিনিতে পারিলেন কি না, তাহা বলিতে পারি না; কিন্তু আমি তাঁহাকে অতি উত্তমরূপে চিনিতে পারিলাম। কালীবাবু যে চরিত্রের লোক, ত্রৈলোক্যের সহিত মিলিত হইয়া নিতান্ত অসৎবৃত্তি অবলম্বন করিয়া সে একাল পর্যন্ত তাহাদের উভয়ের জীবিকা নির্বাহ করিয়া আসিতেছিল, তাহা অতি উত্তমরূপেই অবগত ছিলাম। আমি জানিতাম, দশ হাজার টাকার মূল্যের জহরত খরিদ করিবার ক্ষমতা কালীবাবুর নাই। আরও জানিতাম, কালীবাবুকে যে জানিত, সে দশ হাজার টাকা ত দূরের কথা, দশ পয়সাও দিয়া কালীবাবুকে সহজে বিশ্বাস করিত না।

আমি কালীবাবুর বাড়ীতে গমন করিয়া কেবল রামজীলাল সম্বন্ধে দুই একটা কথা জিজ্ঞাসা করিলাম মাত্র। সবিশেষ কোন কথা তাহার নিকট ভাঙ্গিলাম না, বা তাহার মনে কোনরূপ সন্দেহ হইতে পারে, এরূপ কোন কথাও তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম না। আমার কথায় কালীবাবু, যে কোন উত্তর প্রদান করিলেন, তাহাতেই যেন আমি সন্তুষ্ট হইয়া, রামজীলালের অনুসন্ধান করি বার ভান করিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম।

যে সময় কালীবাবু ও ত্রৈলোক্যের সহিত আমার দুই চারিটী কথা হইয়াছিল, সেই সময় উঁহারা যদি সবিশেষ মনোযোগের সহিত আমার দিকে লক্ষ্য রাখিত, তাহা হইলে উঁহারা সেই সময় আমার কথার উত্তর প্রদান করিতে পারিত কি না, তাহা বলিতে পারি না। কারণ, সেই সময় যেরূপ সতর্কতার সহিত আদি উহা দিগের আপাদমস্তক দর্শন করিতেছিলাম, উঁহারা যদি ঘূণাক্ষরেও আমার সেই সূক্ষ্ম দর্শনের অর্থ বুঝিতে পারি, তাহা হইলে আমি নিশ্চয় বলিতে পারি যে, সেই সময় উঁহারা আমার সম্মুখীন হইয়া কখনই আমার সহিত বাক্যালাপে প্রবৃত্ত হইতে পারি?

না। তাহাদিগের পাপরাশীর ভয়ানক অবস্থা আমি বুঝিতে পারিয়াছি, সেই ভাবিয়া কখনই তাঁহারা কোন পুলিস-কর্ম্মচারীর সম্মুখীন হইতে সাহসী হইত না।

আমার অভিসন্ধির বিষয় যদিও তাঁহারা পূৰ্ব্বে কিছুমাত্র বুঝিতে পারিয়াছিল না; কিন্তু পরিশেষে তাঁহারা আমার সেই সূক্ষ্ম দর্শনের অথ সবিশেষরূপে বুঝিতে সমর্থ হইয়াছিল।

উঁহাদিগকে যে দুই চারিটী কথা আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, এবং তাহার উত্তরে উঁহারা আমাকে যাহা কিছু বলিয়াছিল, তাহার কোন কথাই আমি বিশ্বাস করিতে সমর্থ হইলাম না। অধিকন্তু উঁহাদিগের উপর নানারূপ সন্দেহ আসিয়া আমার মনে উদয় হইল। বস্তুতঃ আমার সমভিব্যাহারী কর্ম্মচারী যেরূপ ভাবে অনুসন্ধান করিয়া রামজীলালের উপর ওয়ারেন্ট বাহির করিয়া রাখিয়াছিলেন, সেই অনুসন্ধানে আমি সন্তুষ্ট হইতে পারিলাম না।

এ সম্বন্ধে আরও একটু সবিশেষরূপ অনুসন্ধান করা আবশ্যক, মনে মনে এইরূপ বিবেচনা করিলাম। কিন্তু কোন উপায় অব লম্বন করিলে, সেইরূপ অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইতে পারি, ভাবিয়া। চিন্তিয়া তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, আমরা উভয়েই থানায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম।

থানায় আসিবার প্রায় দুই তিনঘন্টা পরে হঠাৎ একটা বিষয় জানিবার ইচ্ছা আমার মনে উদয় হইল। এ সম্বন্ধে আমি কাহাকেও কিছু না বলিয়া, সেই কর্ম্মচারীকে সঙ্গে লইয়া করেপি আফিসে গিয়া উপস্থিত হইলাম। ইতিপূর্বে যে কয়েকখানি নম্বরি নোট করেনসি আফিসে ভাঙ্গাইয়া লইয়া রামজীলাল প্রস্থান করিয়াছে—সাব্যস্ত হইয়াছিল, করেসি অফিসের বড় সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, সেই নোট কয়েকখানি একবার দেখিতে চাহিলাম। তিনি তাহার অধীনস্থ কর্ম্মচারীকে আদেশ প্রদান করিলেন, সেই কৰ্ম্মচারী অনুসন্ধান-পূৰ্ব্বক সেই নোট কয়েকখানি বাহির করিয়া আনিয়া আমার হস্তে প্রদান করিলেন। সেই নোট দেখিয়া আমি যে কতদুর বিস্মিত হইলাম, তাহা বলিতে পারি না। কারণ, যে সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া, আমি সেই নোটগুলি দেখিবার ইচ্ছা করিয়াছিলাম, এখন দেখিলাম, সেই সন্দেহ বিশ্বাসে পরিণত হইল। ইতিপূর্বে অনুসন্ধানে আমি অবগত হইতে পারিয়াছিলাম যে, রামজীলাল একজন পশ্চিমদেশীয় লোক, বঙ্গদেশে থাকিয়া ব্যবসা-কাৰ্য্য করিয়া থাকেন বটে; কিন্তু বঙ্গ ভাষার সহিত তাহার কিছুমাত্র সংশ্রব নাই। তিনি না পারেন বাঙ্গালা কহিতে-না পারেন বাঙ্গালা লিখিতে। এখন দেখিলাম, সেই নোটগুলির উপর রামজীলালের নাম স্বাক্ষর আছে সত্য; কিন্তু উহা হিন্দীভাষায় নাই, বাঙ্গালা ভাষায়। রামজীলাল যখন বাঙ্গালা ভাষা একবারেই অবগত নহেন, তখন তিনি বাঙ্গালা ভাষায় আপনার নাম কিরূপে স্বাক্ষর করিলেন, তাহার কিছুই বুঝি উঠিতে পারিলাম না। আরও ভাবিলাম, রামজীলাল যখন সেই সকল অর্থ অপহরণ করিয়া পলায়ন করিতেছে, তখন সে যে আপনার নাম ও ঠিকানা স্পষ্ট করিয়া লিখিয়া দিয়া তাহার বিপক্ষে প্রমাণ সংগ্রহ করিয়া রাখিয়া যাইবে, তাহাই বা সহজে বিশ্বাস করি কি প্রকারে?

মনে মনে এইরূপ ভাবিলাম সত্য; কিন্তু কাহাকেও কিছু না বলিয়া, সেই নোটগুলি করেনসি আফিসে প্রত্যর্পণ-পূৰ্ব্বক আস্তে আস্তে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম।

কালীবাবুর অবস্থা আমি উত্তমরূপে জানিতাম। তাহার নিজের গাড়ি-ঘোড়া নাই, অথচ আড়গোড়া হইতে গাড়ি ভাড়া করিয়া তাহাতে চড়িবার ক্ষমতাও তাহার নাই। এরূপ অবস্থায় কাহার গাড়িতে চড়িয়া সে বাজারে আগমন করিয়াছিল, ক্রমে তাহা জানি বার প্রয়োজন হইয়া পড়িল। রাণীজিই বা কে? সেই জুড়িই বা কাহার? এবং কেইবা সেই জুড়ি আড়গোড়া হইতে ভাড়া করিয়া চড়িয়াছিল, তাহা জানিতে পারিলেই কালীবাবুর কথা যে কতদূর সত্য, তাহা অনায়াসেই অনুমান করা যাইতে পারে। কালীবাবু যে জমিদার-পুত্রের কথা বলিতেছে, তিনি যে কে, তাহা কালীবাবুর জানিতে না পারার কোনরূপ অসম্ভাবনা দেখিতেছি না। যে ব্যক্তি তাহারই রক্ষিতা স্ত্রীলোকের গৃহে আসিয়া আমোদ প্রমোদ করে, যে ব্যক্তি তাহারই গৃহে বসিয়া এত টাকা মূল্যের জহরতাদি খরিদ করে, তাহার পরিচয় কালীবাবু যে একবারেই জানে না, ইহা কিছুতেই বিশ্বাস হইতে পারে না। অন্ততঃ তিনি যে কোথায় থাকেন, তাহা কালীবাবু বা ত্রৈলোক্য যে একবারেই অবগত নহে, তাহাও আমি কোনরূপেই বিশ্বাস করিতে সমর্থ নহি। আমার অনুমান হইতেছে, কালীবাবু যে সকল কথা আমাদিগকে বলিয়াছে, তাহার অধিকাংশই মিথ্যা কথা। সুতরাং এ সম্বন্ধে আমাকে আরও একটু সবিশেষরূপ অনুসন্ধান করিতে হইবে।

এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে আমি আমার থানায় প্রত্যাবর্তন করিলাম। থানার মধ্যে সেই সময় যে সকল ডিটেকটিভ-কর্ম্মচারী উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্য হইতে পশ্চিমদেশীয় এরূপ এক কর্ম্মচারীকে আমি আমার সঙ্গে লইলাম যে, তাঁহাকে সহিসের বেশ পরিধান করাইলে, ঠিক সহিসের মতই বোধ হয়।

সেই কর্ম্মচারীকে আমি সামান্য সহিসের বেশে সজ্জিত হইয়া আমার সহিত আসিতে কহিলাম। তিনি আমার আদেশ মত সহিসের বেশ ধরিয়া আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

বড়বাজারের যে দোকানে রাণীজির জুড়ি এবং কালীবাবুর কম্পাস পাড়ি গমন করিয়াছিল, সেই দোকানের লোজনদিগের নিকট হইতে সেই গাড়ির সহিস-কোচবানগণের পোযাকের বিবরণ শুনিয়া আমি সেই সময়েই স্থির করিয়াছিলাম যে, সেই দুইখানি গাড়ি কোন আড়গোড়া হইতে আনীত হইয়াছে। কারণ, কলিকাতার পাঠকগণের মধ্যে অনেকেই অবগত আছেন যে, কলিকাতার প্রত্যেক আড়গোড়ার সহিস-কোচবানদিগের পরিচ্ছদ এক এক প্রকার।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

সহিস-বেশধারী কর্ম্মচারীকে সঙ্গে লইয়া আমি থানা হইতে বহির্গত হইলাম। সহিস-কোচবানের পোষাক পরিচ্ছদের বিবরণ শুনিয়া আমি মনে মনে যে আড়গোড়া স্থির করিয়াছিলাম, সেই আড়গোড়ায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। আমি সেই আড়গোড়ার ভিতর একটী ঘোড়া ক্রয় করিবার ছলে প্রবেশ করিয়া আড়গোড়ায় যে সকল ঘোড়া ছিল, তাহাই দেখিবার ভানে এদিক ওদিক বেড়াইতে লাগিলাম; কিন্তু সহিস-বেশধারী কর্ম্মচারীর দৃষ্টিপথের বাহির হইলাম না। অধিকন্তু অপরাপর সহিস-কোচবানদিগের সহিত সেই কৰ্মচারীর যে সকল কথা হইতে লাগিল, তাহার দিকেও সবিশেষরূপ লক্ষ্য রাখিলাম।

সহিস-বেশধারী কর্ম্মচারী আমার উপদেশ মত আড়গোড়ার ভিতর প্রবেশ করিয়া যে স্থানে কয়েকজন সহিস-কোচবান বসিয়া ছিল, সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন, এবং আপনাকে একজন সহিস বলিয়া পরিচয় দিয়া তাহাদিগের নিকট উপবেশন করিলেন। তাহাকে দেখিয়া একজন কোচবান্ জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কাহার অনুসন্ধান করিতেছ?

কৰ্ম্মচারী। কাহারও অনুসন্ধান করিতেছি না।

কোচবান্। তবে এখানে আসিয়াছ কেন?

কর্ম্মচারী। আমি বরাবর সহিসী কৰ্ম্ম করিতাম; কিন্তু আজ কয়েকমাস হইল, আমি আমার দেশে গমন করিয়াছিলাম, এবং কিছু দিন পূর্বে আমি দেশ হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়াছি। এখন কোন স্থানে কোনরূপ চাকরী যোগাড় করিতে না পারায়, সবিশেষরূপ কষ্ট পাইতেছি। তাই একটা চাকরীর অনুসন্ধানে আপনাদিগের এখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি।

কোচবান। এখানে তোমার চাকরী হইতে পারে, একথা তোমাকে কে বলিল?

কর্ম্মচারী। একথা আমাকে কেহ বলে নাই। আড়গোড়ায় অনেক সহিস কাৰ্য্য করে; সুতরাং সময় সময় অনেক চাকরী প্রায়ই খালি খাকার সম্ভাবনা। তাই আপনাদিগের এখানে আগমন করিয়াছি। এখন বলুন, কিরূপ উপায়ে আমি একটা চাকরী যোগাড় করিতে সমর্থ হই?

কোচবান্। আমাদিগের এখানে যদি কোন কৰ্ম্ম খালি থাকিত, তাহা হইলে আমাদিগের সাহেবকে বলিয়া যাহাতে তুমি কোন একটী কৰ্ম্ম পাইতে পারিতে, আমি তাহার বন্দোবস্ত করিতাম; কিন্তু আজকাল সহিসের কাৰ্য খালি থাকা দূরে থাকুক, দুই একজন সহিস আমাদিগের এখানে ফালতু পড়িয়া আছে।

কর্ম্মচারী। এখানে বড় আশা করিয়া আসিয়াছিলাম, কিন্তু এখন দেখিতেছি, আমার সে আশা এখন কার্যে পরিণত হওয়া কঠিন হইয়া দাঁড়াইল।

কোচবান্। এখানে মধ্যে মধ্যে প্রায়ই সহিসী কাৰ্য্য খালি হইয়া থাকে। তুমি দুই একদিবস অন্তর এক একবার আসিও, খালি হইলেই আমি তোমার জন্য একটী যোগাড় করিয়া দিব।

কর্ম্মচারী। তাহাই হইবে। আমি মধ্যে মধ্যে আসিয়া আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব। আজ কয়েকদিবস হইল, বড়বাজারে একখানি জুড়ি গাড়ি এবং একখানি কম্পাস গাড়ি আপনাদিগের এখান হইতে গিয়াছিল, তাহাদিগের মধ্যে কোন সহিস কোচবানের সহিত একবার সাক্ষাৎ হয় কি?

কোচবান্। কেন?

কর্ম্মচারী। তাহা হইলে বোধ হয়, আমার একটী চাকরীর যোগাড় হইতে পারে।

কোচবান্। সেই সহিস কোচবানের নাম কি?

কর্ম্মচারী। আমি তাহাদিগের কাহারও নাম অবগত নহি।

কোচবান্। নাম না জানিলে, তুমি কাহার সহিত সাক্ষাৎ করিবে?

কর্ম্মচারী। দুইজন কোচবান্ এবং তিনজন সহিস দুইখানি গাড়িতে ছিল। তাহাদিগের মধ্যে একজনের সহিত সাক্ষাৎ হইলেই আমার কাৰ্য শেষ হইতে পারে।

রাণী না খুনী?

কোচবান্। প্রত্যহই গাড়ি ভাড়ায় যাইতেছে; বড়বাজারে কে গিয়াছিল, তাহা এখন কিরূপে স্থির করিব?

কর্ম্মচারী। দুইখানি গাড়ি গিয়াছিল। একখানি জুড়ি গাড়ি, তাহাতে একজন রাণী ছিলেন। সেই রাণী বড়বাজারে একজন জহরত-বিক্রেতার দোকানে গমন করিয়া অনেকগুলি জহরত খরিদ করিয়াছিলেন। আর একখানি কম্পাস গাড়ি; বড়বাজারে গমন করিবার সময় উহাতে কেবলমাত্র একটী লোক গমন করিয়াছিল, কিন্তু আসিবার সময় তাহাতে দুইজন আগমন করেন, এবং তাহাদের সহিত সেই জহরতের বাক্সও আনা হয়। এরূপ অবস্থায় যদি আপনি এইখানকার সহিস-কোচবানগণকে জিজ্ঞাসা করেন, তাহা হইলে বোধ হয়, তাহাদিগের সন্ধান নিশ্চয়ই অনা মাসে হইতে পারে।

কোচবান্। সে আজ কয়দিবসের কথা?

কর্ম্মচারী। প্রায় আট দশদিবস হইবে।

কর্ম্মচারীর এই কথা শুনিয়া সেই কোচবান সেই স্থানে যে সকল সহিস-কোচবান্ উপস্থিত ছিল, তাহাদিগের প্রত্যেককেই জিজ্ঞাসা করিলেন। উঁহাদিগের মধ্যে একজন সহিস কহিল, আজ আট দশদিবস হইল, কোন রাণীকে সোয়ারী দিবার নিমিত্ত লাল বড় জুড়িতে হোসেনী কোচবান্ যেন গমন করিয়াছিল, এইরূপ আমার মনে হইতেছে।

কোচবান্। হোসেনী, কোন্ হোসেনী?

সহিস। বড় লাল জুড়ি যে হোসেনী হাঁকাইয়া থাকে।

কোচবান। দেখ দেখি, হোসেনী এখন আছে, কি সোয়ারীতে বাহির হইয়া গিয়াছে।

সহিস। সে এখন নাই। অনেকক্ষণ হইল, সে সেই জুভি লইয়া বাহির হইয়া গিয়াছে।

কোচবান্। তাহার সহিত যে দুইজন সহিস ছিল, তাহাদের মধ্যে কেহ আছে কি?

সহিস। না, তাঁহারাও হোসেনীর সহিত বাহির হইয়া গিয়াছে বলিয়া বোধ হইতেছে। যাহা হউক, আমি গিয়া আস্তাবলের ভিতর তাহাদিগের একবার অনুসন্ধান করিয়া আসিতেছি। উহা দিগের মধ্যে যদি কেহ থাকে, তাহা হইলে আমি তাহাকে সঙ্গে লইয়া আনিতেছি।

এই বলিয়া সেই সহিদ সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল, এবং অতি অল্পক্ষণ মধ্যেই আর একজন লোককে সঙ্গে করিয়া সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল ও কহিল, জুড়ি গাড়ির কোচবান্ ও সহিসগণ সকলেই বাহির হইয়া গিয়াছে। সেই জুড়ির সহিত যে একখানি কম্পাস গাড়ি গমন করিয়াছিল, তাহার কোচবান্ এই–আবদুল।

কোচবান্। আবদুল! তুমিই কি কম্পাস গাড়ি লইয়া হোসেনীর জুড়ির সহিত কোন রাণীকে লইয়া বড়বাজারে গমন করিয়াছিলে?

আবদুল। আমি গাড়ি চড়াইয়া রাণীকে লইয়া যাই নাই। রাণী গিয়াছিলেন-জুড়িতে; আমি জুড়ির পিছু পিছু গিয়াছিলাম।

কর্ম্মচারী। আচ্ছা, রাণী জুড়িগাড়িতে করিয়া গিয়াছিলেন; কিন্তু তোমার গাড়ি ত খালি যায় নাই, তাহাতে একটী বাবু গমন করিয়াছিলেন না?

২য় কোচবান্। হাঁ।

কর্ম্মচারী। আসিবার সময় দুইজন বাবু তোমার গাড়িতে আসিয়াছিলেন?

২য় কোচবান্। হাঁ।

কর্ম্মচারী। যে বাবু তোমার গাড়িতে বড়বাজারে গমন করিয়া ছিলেন, তাহার সহিত বড়বাজারে আমার সহিত সাক্ষাৎ হয়। তিনি আমাকে বলিয়াছিলেন, তুমি আমার বাড়ীতে যাইও, সেই স্থানে গেলে, আমি তোমাকে একটা চাকরীর যোগাড় কুরিয়া দিব। তাহার নাম ও ঠিকানা পর্যন্ত আমাকে বলিয়া দিয়াছিলেন। কিন্তু ভাই, দুঃখের কথা আর কি বলিব, আমি তাঁহার নাম ও ঠিকানা উভয়ই ভুলিয়া গিয়াছি বলিয়া, আর সেই স্থানে গমন করিতে পারি নাই, এবং এখন কোন স্থানে চাকরীর ও যোগাড় করিয়া উঠিতে পারি নাই। তাহার নাম ও ঠিকানা ভুলিয়া যাইবার পরে, এই কয়দিবস পৰ্য্যন্ত যে কত স্থানে চাকরীর উমেদারীতে ঘূরিয়া বেড়াইয়াছি, তাহার আর তোমাকে কি বুলিব?

সহিস। আমাকে এখন কি করিতে হইবে?

কর্ম্মচারী। ভাই, অনেক কষ্ট করিয়া যখন আমি তোমার অনুসন্ধান করিতে সমর্থ হইয়াছি, তখন আর আমি তোমাকে সহজে ছাড়িতেছি না; এখন তোমার প্রতি আমার এই অনুরোধ যে, হয় কোন স্থানে আমার একটী চাকরীর যোগাড় করিয়া দেও, না হয়, সেই বাবুর বাড়ী, যাহা তোমার দেখা আছে, একটু কষ্ট স্বীকার করিয়া তাহা আমাকে দেখাইয়া দিয়া আমাকে সবিশেষরূপে উপকৃত কর।

সহিস। আমার হাতের কাৰ্য আমি এখন পর্যন্ত শেষ করিয়া উঠিতে পারি নাই। এরূপ অবস্থায় আমি কিরূপে আপনার সঙ্গে এখন গমন করিতে পারি?

কর্ম্মচারী। আমার যতদূর সাধ্য, আমি না হয়, তোমার কার্য্যের কতক সাহায্য করিতেছি, তাহা হইলে তোমার কাৰ্য্য শীঘ্রই সম্পন্ন হইয়া যাইবে। তাহা হইলে ত তুমি আমার সহিত গমন করিতে পারিবে?

ছদ্মবেশী-কর্ম্মচারীর এই কথা শুনিয়া সেই কোচ প্রথমতঃ তাঁহার সহিত যাইতে অস্বীকার করিল। পরিশেষে অনেক তোষামোদের পর তাহার সহিত যাইতে স্বীকৃত হইয়া শীঘ্র শীঘ্র আপনার নিয়মিত কৰ্ম্ম সমাধা করিয়া লইবার মানসে সেই ছদ্ম বেশী-কর্ম্মচারীকে নানারূপ ফরমাইস আরম্ভ করিল। কখন বা তাহাকে ঘোড়ার সাজ সরাইয়া দিতে কহিল, কখন বা ঘোড়ার থাকিবার স্থানে পাতিয়া দিবার খড় গুলি যাহা রৌদ্রে শুখাইতে দেওয়া হইয়াছিল, তাহা সেই স্থান আনিতে কহিল। এইরূপে তাহাকে নানারূপ ফরমাইস আরম্ভ করিল। ছদ্মবেশী-কর্ম্মচারী কি করেন, কোন গতিতে তাঁহার কাৰ্য-উদ্ধার করিতেই হইবে; সুতরাং সেই কোচবানকে তিনি সর্ব প্রকার সাহায্য করিতে লাগিলেন। মধ্যে মধ্যে তামাক সাজিয়াও তাহাকে খাওয়াইতে হইল। এইরূপে প্রায় দুইঘণ্টাকাল অতীত হইলে আবদুল সেই কর্ম্মচারীর সহিত বহির্গত হইল। আমিও ঘোড় দেখা শেষ করিয়া তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎসেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম।

যষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

আড়গোড়া হইতে বাহির হইয়া কর্ম্মচারী আবদুলের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। আমিও একটু দুরে থাকিয়া তাহাদের অনুসরণ করিতে লাগিলাম।

গমন করিতে করিতে কর্ম্মচারী আবদুলকে জিজ্ঞাসা করি লেন, কেমন ভাই, তোমার গাড়িতে যে বাবুটী বড়বাজারে গমন করিয়াছিলেন, তিনি একাকী গমন করিয়াছিলেন, কি তাহা সহিত অপর আর কোন ব্যক্তি ছিল?

আবদুল। তিনি একাকীই আমার গাড়িতে গমন করিয়া ছিলেন।

কর্ম্মচারী। বড়বাজার হইতে যখন প্রত্যাবর্তন করেন, তখনও কি তিনি একাকী ছিলেন?

আবদুল। না, বড়বাজার হইতে আসিবার সময় অপর আর একটা লোক তাঁহার সহিত আগমন করিয়াছিলেন।

কর্ম্মচারী। যে ব্যক্তি তোমার গাড়িতে গমন করিয়াছিলেন, তাঁহাকে কোন্ দেশীয় লোক বলিয়া তোমার অনুমান হয়?

আবদুল। তিনি বাঙ্গালি।

কর্ম্মচারী। আর যে ব্যক্তি বড়বাজার হইতে তাহার সহিত আগমন করিয়াছিলেন, তিনিও কি বাঙ্গালি?

আবদুল। না, তিনি বাঙ্গালি নহেন। তাহাকে মাড়োয়ারী বা ক্ষেত্র বলিয়া আমার অনুমান হয়। তিনি বাঙ্গালি নহে, ইহা আমি বেশ বলিতে পারি।

কর্ম্মচারী। যিনি তোমার গাড়িতে বড়বাজারে গমন করেন, তিনি যে বাড়ী হইতে গমন করিয়াছিলেন, বড়বাজার হইতে ফিরিয়া আসিয়াও কি তিনি সেই বাড়ীতে গমন করিয়াছিলেন, কি অপর কোন বাড়ীতে গিয়াছিলেন?

আবদুল। অপর কোন বাড়ীতে তিনি গমন করেন নাই। যে বাড়ী হইতে আসিয়াছিলেন, পুনরায় সেই বাড়ীতেই গমন করিয়াছিলেন।

কর্ম্মচারী। তোমার গাড়ি ও জুড়িগাড়ি, উভয় গাড়িই কি এক সময় যাইয়া সেই বাড়ীতে উপস্থিত হয়?

আবদুল। আমাদিগের উভয় গাড়িই এক সময় সেই বাড়ীতে গিয়াছিল, এবং সেই স্থান হইতে উভয় গাড়িই একত্র বড়বাজার গমন করে।

কর্ম্মচারী। আর বড়বাজার হইতে যখন তোম প্রত্যাবর্তন কর, সেই সময়েও বোধ হয়, তোমাদের উভয় গাড়িই একত্র ফিরিয়া আইসে?

আবদুল। না, জুড়িগাড়ি অগ্রে চলিয়া আইসে; আমার গাড়ি তাহার অনেক পশ্চাৎ আসিয়াছিল।

কর্ম্মচারী। জুড়িগাড়িতে কে ছিল?

আবদুল। কে ছিল তাহা আমি জানি না। কেবল একটী মাত্র স্ত্রীলোককে সেই গাড়িতে উঠিতে দেখিয়াছিলাম।

কর্ম্মচারী। সেই স্ত্রীলোকটীর পোয়াক-পরিচ্ছদ কিরূপ ছিল?

আবদুল। পোষাক-পরিচ্ছদ খুব ভাল ছিল। শুনিয়াছি, উনি নাকি কোন স্থানে যাণী। তা রাণীর পোষাক আর ভাল হইবে না?

কর্ম্মচারী। যে বাড়ী হইতে সেই বাবুটা তোমার গাড়িতে উঠিয়াছিলেন, এবং পরিশেষে বড়বাজার হইতে ফিরিয়া আসিয়া যে বাড়ীতে গমন করেন, সেই রাণীও কি সেই বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া জুড়িতে আরোহণ করিয়াছিলেন?

আবদুল। হাঁ, তিনিও সেই বাড়ী হইতে বাহির হইয়া জুড়িতে উঠিয়াছিলেন, ইহা আমি দেখিয়াছি; কিন্তু কোন্ বাড়ীতে যে তিনি নামিয়া গিয়াছেন, তাহা আমি বলিতে পারি না।

কর্ম্মচারী। কয়দিবসের নিমিত্ত উঁহারা গাড়ি দুইখানি ভাড়া করিয়াছিলেন?

আবদুল। কেবলমাত্র একদিবসের জন্য। যে দিবস উঁহারা বড়বাজার গমন করিয়াছিলেন, কেবলমাত্র সেই দিবসই আমরা আসিয়াছিলাম, উহার পূর্বে বা পরে আর কখনও আমরা তাঁহাদিগের নিকট গাড়ি লইয়া যাই নাই।

কর্ম্মচারী। তোনরা কি সেই বাবুকে, কি রাণীকে পূর্ব হইতে চিনিতে।

আবদুল। না।

কর্ম্মচারী। তাহাদিগের বাড়ী?

আবদুল। তাহাও আমরা পূর্ব হইতে জানিতাম না।

কর্ম্মচারী। তাহা হইলে কিরূপে তোমরা তোমাদিগের গাড়ি লইয়া তাহাদিগের বাড়ীতে যাইতে পারিলে?

আবদুল। আমাদিগের আফিসের সাহেবগণের সহিত উহা দিগের কিরূপ বন্দোবস্ত ছিল, তাহা আমি জানি না; কিন্তু সে দিবস আমরা গাড়ি লইয়া গিয়াছিলাম, সেই দিবস যে বাবু আমার গাড়িতে বড়বাজারে গমন করিয়াছিলেন, তিনিই আমাদিগের আফিসে আসিয়াছিলেন, এবং তিনিই আমার গাড়িতে চড়িয়া আড়গোড়া হইতে আমাদিগের গাড়ি তাঁহার সেই বাড়ীতে লইয়া যান। পরিশেষে তিনিই আমার গাড়িতে বড়বাজারে গমন করেন, এবং সেই স্থান হইতে প্রত্যাবর্তন করেন।

কর্ম্মচারী। তোমাদিগের গাড়ির যে ভাড়া হইয়াছিল, তাহা তাঁহারা তোমাদিগের নিকট প্রদান করিয়াছিলেন কি?

আবদুল। না, ভাড়া আমাদিগের হস্তে প্রদান করিবেন কেন?

কৰ্ম্মচারী। তবে কি গাড়ির ভাড়া পরিশেষে তাহার নিকট হইতে আদায় করিয়া লওয়া হয়? আবদুল। গাড়ির ভাড়া পূৰ্ব্বে জমা দিয়া গাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়, কি পরিশেষে তাহাদিগের নিকট হইতে ভাড়া আদায় করা হয়, কি একবারেই ভাড়া লওয়া হয় নাই, তাহার কিছুমাত্র আমি অবগত নহি।

আবদুলের সহিত এইরূপে কর্ম্মচারীর কথাবার্তা হইতে হইতে উভয়েই গিয়া একখানি দ্বিতল বাড়ীর সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। সেই স্থানে গমন করিয়াই, আবদুল সেই রাড়ী দেখাইয়া দিয়া কহিল, এই বাড়ী। আবদুলের এই কথা শুনিয়াই কর্ম্মচারী সেই স্থানে একটু দাড়াইলেন; দেখিলেন, উহা বড়গোছের একটী দ্বিতল বাটী; কিন্তু সেই বাটীর দরজা খোলা নাই। বাহির হইতে সদর দরজা তালাবদ্ধ। সেই বাটর অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল, উহা একখানি খালি বাড়ী। সেই বাড়ীর দরজায় একখানি কাগজ মারা ছিল, উহাতে লেখাছিল, এই বাড়ী ভাড়া দেওয়া যাইবে। সম্মুখের মুদীর দোকানে অনুসন্ধান করিলে, এই বাড়ীর অবস্থা অবগত হইতে পারিবেন।

আমাদিগের উদ্দেশ্য কিয়ৎ পরিমাণে সিদ্ধ হইল। তখন কর্ম্মচারী আবদুলকে কহিলেন, ভাই, তুমি আমার নিমিত্ত যে এত পরিশ্রম ও কষ্ট স্বীকার করিলে, কিন্তু তাহার ফল কিছুই ফলিল না।

আবদুল। কেন?

কর্ম্মচারী। আমার আজকাল এমনই দুরদৃষ্ট হইয়াছে যে, যে ব্যক্তি নিজে আমাকে একটী চাকরী দিবেন বলিয়া, আমাকে তাঁহার বাড়ীতে আসিতে কহিলেন, আমার দুর্ভাগ্য বশতঃ তিনি সেই বাটী পরিত্যাগ করিয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছেন! যাহা হউক ভাই, তোমাকে আমি আর অধিক কষ্ট দিতে চাহি না, তুমি এখন আপন স্থানে গমন কর। কিন্তু ভাই, সবিশেষ চেষ্টা করিয়া দেখিও, যদি তোমাদিগের ওখানে আমার একটী কাৰ্য্যের যোগাড় হয়। আমি মধ্যে মধ্যে গিয়া তোমার এবং কোচবানজির সহিত সাক্ষাৎ করিব।

কর্ম্মচারীর এই কথা শুনিয়া আবদুল সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। কৰ্ম্মচারীও অপর আর একটী গলির ভিতর প্রবেশ করিলেন।

এ পর্যন্ত আমি তাহাদিগের সন্নিকটেই ছিলাম। আবদুল সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলে পর, কর্ম্মচারী আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন ও কহিলেন, এ পর্যন্ত সহিসের সহিত আমার যে সকল কথা হইয়াছে, তাহার আদ্যোপান্ত আপনি শুনিয়াছেন ত?

আমি। সমস্তই শুনিয়াছি।

কর্ম্মচারী। উঁহারা যে বাড়ী ভাড়া লইয়াছিল, সে বাড়ীও দেখিয়াছেন?

আমি। তাহাও দেখিয়াছি। উহা এখন তালাবদ্ধ।

কর্ম্মচারী। এখন আর কি করিতে হইবে?

আমি। এখন দেখিতে হইবে, এই বাড়ী ভাড়া কে লইয়া ছিল। যে রাণী এই বাড়ী ভাড়া লইয়াছিল, তাহার যদি কোন রূপ সন্ধান করিতে পারি, তাহা হইলে অনেক কথা বাহির হই বার সম্ভাবনা।

কর্ম্মচারী। কিরূপ উপায়ে রাণীর সন্ধান পাওয়া যাইতে পারিবে?

আমি। যাহার বাড়ী ভাড়া লইয়াছিল, তিনি যদি কোনরূপ সন্ধান বলিয়া দিতে পারেন।

কর্ম্মচারী। তবে চলুন, কাহার বাড়ী, অনুসন্ধান করিয়া বাহির করা যাউক।

আমি। অদ্য রাত্রি হইয়া আসিয়াছে, রাত্রিকালে এ কার্যের সুবিধা হইবে না; কল্য প্রাতঃকালে ইহার বন্দোবস্ত করিব। তদ্ব্যতীত আরও একটী কাৰ্য্য আমাদিগের বাকী থাকিল, যে ব্যক্তি আড়গোড়া হইতে গাড়ি ভাড়া করিয়া এই বাড়ীতে আসিয়া ছিল, সেই ব্যক্তি কালীবাবু কি না। তাহাও আবদুল প্রভৃতির নিকট হইতে আমাদিগকে জানিয়া লইতে হইবে।

এইরূপ পরামর্শ করিয়া আমরা সে দিবস আপন আপন স্থানে প্রস্থান করিলাম।

সপ্তম পরিচ্ছেদ।

সেই রাত্রিতে এ সম্বন্ধে আর কোনরূপ অনুসন্ধান করিলাম না। পরদিবস অতি প্রত্যূষে উঠিয়া যে বাড়ী রাণীজি ভাড়া করিয়াছিলেন, সেই বাড়ীর উদ্দেশে গমন করিলাম। দিবাভাগে সেই বাড়ীটী আর একবার দেখিয়া লইলাম, দরজার উপর যে কাগজ লাগান ছিল, তাহা হইতে বাড়ীর অধিকারীর নাম এবং তাঁহার ঠিকানা লিখিয়া লইলাম। সেই বাড়ীর সন্নিকটে যে একটা মুদীর দোকান ছিল, সেই মুদী এই বাড়ী সম্বন্ধে কোন কথা অবগত আছে কি না, তাহা জানিবার জন্য তাঁহার নিকটেও একবার গমন করিলাম, এবং তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, এই বাড়ীটী কি ভাড়া দেওয়া যাইবে?

মুদী। এই বাড়ীতে প্রায়ই ভাড়াটিয়া থাকে, যদি উহা খালি থাকে, তাহা হইলে নিশ্চয়ই উহা ভাড়া দেওয়া হইবে।

মামি। সেই বাড়ী এখন খালি আছে, কি অপর কোন ব্যক্তি উহা গ্রহণ করিয়াছে, তাহা আপনি অবগত আছেন কি?

মুদী। আমার বোধ হয়, এই বাড়ী খালি নাই, উহা ভাড়া হইয়া গিয়াছে।

আমি। আপনি জানেন, কে উহা ভাড়া লইয়াছে?

মুদী। তাহা আমি জানি না।

আমি। তবে আপনি কিরূপে জানিলেন যে, সেই বাড়ী ভাড়া হইয়া গিয়াছে?

মুদী। আজ কয়েকদিবস হইল, আমি এই বাড়ীর দরজা খোলা দেখিতে পাই। আরও দেখিতে পাই, সেই দরজার সম্মুখে একখানি জুড়িগাড়ি ও একখানি কম্পাস গাড়ি দাড়াইয়াছিল। তাহাতেই আমি অনুমান করিতেছি, কোন বড়লোক এই বাড়ী ভাড়া লইয়া থাকিবে।

আমি। আমি এই বাড়ীর সম্মুখে গিয়াছিলাম, দেখিলাম, উহার দরজায় লেখা আছে, এই বাড়ী ভাড়া দেওয়া যাইবে। এবং সদর দরজা তালা দ্বারা বন্ধ করাও আছে।

মুদী। তাহা হইলে বোধ হয়, এই বাড়ী এখনও খালি আছে।

আমি। আপনি জানেন, এই বাড়ীর ভাড়া কত?

মুদী। না মহাশয়! তাহা আমি অবগত নহি।

আমি। এই বাড়ীর চাবি কাহার নিকট থাকে, তাহা আপনি বলিতে পারেন কি?

মুদী। না মহাশয়! তাহা আমি জানি না। দরজায় যে কাপজ মারা আছে, তাহাতে লেখা নাই?

আমি। যে স্থানে এই বাড়ী সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিতে হইবে, তাহা লেখা আছে; কিন্তু কোন্ স্থানে এই বাড়ীর চাবি আছে, তাহা লেখা নাই। তাহাই আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতে ছিলাম।

মুদী। তাহা হইলে মালিকের বাটীতে গমন করিলেই সমস্ত বিষয় অবগত হইতে পারিবেন, এবং বাড়ীর চাবিও পাইবেন।

আমি। সেই ভাল, তাহা হইলে আমি সেই স্থানেই গমন করি।

এই বলিয়া আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিয়া সেই বাটীর মালিকের উদ্দেশে চলিলাম। বাটীর দরজার উপর যে ঠিকানা লেখা ছিল, সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া একটু অনুসন্ধান করাতেই সেই বাটীর মালিকের সহিত সাক্ষাৎ হইল। তিনি তাহার বাটী হইতে বাহিরে আসিয়াই আমাকে জিজ্ঞাসা করি লেন, আপনি কি নিমিত্ত আমার অনুসন্ধান করিতেছেন?

আমি। আপনার যে একখানি বাটী খালি আছে, তাহা আপনি ভাড়া দিবেন কি?

মালিক। হাঁ, আমার বাটী খালি আছে, এবং উহা ভাড়াও দেওয়া যাইবে; কিন্তু আজকাল নহে। দিনকতক পরে আসিলেই সেই বাটী আপনি পাইতে পারিবেন।

আমি। আপনার সেই বাটীর ভাড়া কত? মালিক। পঞ্চাশ টাকা।

আমি। এখন সেই বাটী ভাড়া দিতে আপনার সবিশেষ কোনরূপ প্রতিবন্ধক আছে কি?

মালিক। না থাকিলে আর আমি আপনাকে বলিব কেন?

আমি। কি প্রতিবন্ধক আছে, তাহা আমি জানিতে পারি কি?

মালিক। অপর কোনরূপ প্রতিবন্ধক নাই। আজ কয়েক দিবস হইল, একটী বাবু, একমাসের অগ্রিম ভাড়া দিয়া একমাসের নিমিত্ত সেই বাটী ভাড়া লন, এবং আমার নিকট হইতে সেই বাটীর চাবি লইয়া যান। যখন তিনি সেই বাটী ভাড়া লন, তখন তিনি বলিয়াছিলেন, পশ্চিমদেশ হইতে একজন রাণী কলি কাতা দেখিবার নিমিত্ত আগমন করিবেন, এবং তিনিই সেই বাড়ীতে দশ বারদিন থাকিবেন মাত্র। সেই বাবুটী আমাকে এই কথা বলিয়া আমার বাড়ী ভাড়া লন, এবং বাড়ীর চাবি লইয়া যান। দুই তিনদিবস পরেই সেই বাড়ীর চাবি তিনি আমাকে ফিরাইয়া দিয়া যান, ও বলিয়া যান যে, রাণীজির বোধ হয়, এখন আসা হইল না। তবে যদি ইহার মধ্যে তিনি আইসেন, তাহা হইলে আমি আসিয়া পুনরায় চাবি লইয়া যাইব। একমাসের মধ্যে যদি তিনি আসেন, তাহা হইলে সেই বাড়ী আপনি অপরকে একমাস পরে অনায়াসেই ভাড়া দিতে পারেন। এখন বলুন দেখি মহাশয়! একমাসের মধ্যে আমি সেই বাড়ী অপরকে কিরূপে ভাড়া দিতে পারি? প্রকৃত প্রস্তাবে বলিতে হইলে, সেই বাড়ী আমার হইলেও একমাসের মধ্যে উহাতে হস্তক্ষেপ করিবার ক্ষমতা আমার নাই।

আমি। একমাস পরে সেই বাড়ী ভাড়া দিতে আপনার বোধ হয়, আর কোনরূপ আপত্তি হইবে না।

মালিক। কিছু না। একমাস কেন, একমাসের প্রায় অর্ধেক গত হইয়া গেল, যে কয়দিবস বাকী আছে, তাহার পরে সেই বাড়ী ভাড়া দিতে আর কোনরূপ আপত্তি নাই।

আমি। এই কয়দিবসের মধ্যে আপনি বাড়ী ভাড়া না দিন। কিন্তু উহা একবার দেখিতে বোধ হয়, আপনার কোনরূপ আপত্তি নাই?

মালিক। তাহাতে আর আপত্তি কি? আপনার যখন ইচ্ছা হয়, তখনই আপনি গিয়া আমার বাড়ী দেখিতে পারেন।

আমি। আপনার যদি কোনরূপ আপত্তি না থাকে, তাহা হইলে এখনই গিয়া আমি আপনার বাড়ী দেখিয়া আসিতে পারি। বাটী দেখিয়া যদি আমার মনমত হয়, তাহা হইলে সেই বাট ভাড়া লইয়া কথাবার্তা শেষও হইয়া যাইতে পারে।

মালিক। আপনাকে বাটী দেখাইতে আমার কিছুমাত্র আপতি নাই; কিন্তু আপনার সহিত গমন করিতে পারে, এরূপ কোন লোক এখন এ স্থানে উপস্থিত নাই। আমারও কোন একটা সবিশেষ প্রয়োজনে এখনই বাহির হইয়া যাইতেছি। সুতরাং আমিও এখন আপনার সহিত গমন করিতে পারিতেছি না। আপনি অনুগ্রহপূর্বক অপর কোন সময়ে আগমন করিবেন, সেই সময় হয় আমি নিজে আপনার সহিত গমন করিব, না হয়, অপর কোন লোককে আপনার সঙ্গে পাঠাইয়া দিব। আমি এখনই সেই বাটীর চাবি আপনার হস্তে প্রদান করিতাম; কিন্তু মহাশয়! মার্জনা করি বেন, আপনি আমার নিকট একবারে অপরিচিত বলিয়া, সেই বাটীর চাবি আপনার হস্তে প্রদান করিতে পারিলাম না। কলি কাতা সহর, অনেক দেখিয়া শুনিয়া চলিতে হয়।

আমি। আচ্ছা মহাশয়! তাহাই হইবে। অপর আর এক সময় আসিয়া আমি আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব, এবং সেই সময় চাবি লইয়া গিয়া আপনার বাটী দেখিয়া লইব।

মালিক। তাহা হইলে আমি এখন আমার কাৰ্য্যে গমন করিতে পারি?

আমি। আর একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি।

মালিক। আর কি জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন?

আমি। যে বাবুটা আপনার নিকট হইতে একমাসের জন্য বাটী ভাড়া লইয়াছিল, তাহাকে আপনি চিনেন কি?

মালিক। তিনি আমার নিকট পরিচিত নহেন।

আমি। তিনি কোথায় থাকেন, তাহা আপনি বলিতে পারেন?

মালিক। না।

আমি। আমি যদি অনুসন্ধান করিয়া তাহাকে আপনার নিকট আনিতে পারি, এবং এখন হইতে আমাকে সেই বাটী ভাড়া দিতে যদি তাঁহার কোনরূপ আপত্তি না থাকে, তাহা হইলে সেই বাটী আপনি আমাকে ভাড়া দিতে পারিবেন কি?

মালিক। তাহা পারিব না কেন, তাহার কোনরূপ আপত্তি না থাকিলেই হইল।

সেই বাটীর মালিকের সহিত এইরূপ কথাবার্তা হইবার পর, অপর আর কোন সময়ে পুনরায় তাহার নিকট আগমন করিব, এই বলিয়া আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম; তিনিও আপন কার্যে গমন করিলেন।

প্রথম অংশ সম্পূর্ণ।

শুক্রবার, ৭ জুন, ২০১৯

 ১১০টি ঈশপের গল্প

১১০টি ঈশপের গল্প

পএই ইবুকটি উৎসর্গ করলাম শিশির শুভ্র ভাই কে।
ইবুক – সঞ্জয় হুমানিয়া


           ১১০টি ঈশপের গল্প

ঈশপের গল্প (১ – ৫)

ছোটবেলায় প্রথম যে বইটি পড়ে দুনিয়ায় টিঁকে থাকার রীতি-নীতি সম্পর্কে জানতে পারি সেটি ছিল ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর-এর করা ঈশপ-এর গল্পের অনুবাদ – ‘কথামালা’। আমার বাবার আমাকে প্রথম উপহার যা আমার মনে পড়ে। বইটি হারিয়ে গেছে। গল্পগুলি রয়ে গেছে মনের ভিতর। যত বড় হয়েছি, গল্পগুলি তত বেশী করে অনুভব করেছি। আবার কখনো কখনো সেগুলি থেকে অন্য রকমের মজা পেয়েছি। সম্প্রতি ইচ্ছে হচ্ছিল গল্পগুলি ফিরে পড়ার। ভাবলাম, আপনাদের-ও সঙ্গী করে নি-ই। ইংরেজী পাঠের অনুসারী বঙ্গানুবাদ করেছি, তবে আক্ষরিক নয়। সাথে ফাউ হিসেবে থাকছে আমার দু-এক কথা।


(১)The Wolf Turned Shepherd
রাখাল সাজা নেকড়ে
ধরা খাওয়ার ভয়ে এক নেকড়ে কিছুতেই ভেড়ার পালের কাছ ঘেঁষতে পারে না। তখন জামা-কাপড় চাপিয়ে সে এক রাখাল সেজে নিল। এইবার সে সোজা চলে এল ভেড়াগুলোর পাশে। আসল রাখাল তখন ঘুম লাগাচ্ছে আর ভেড়াগুলো নিশ্চিন্তে ঘাস খাচ্ছে। মুস্কিলটা হল ভেড়া পাকড়াতে গেলে অন্ততঃ কোন একটাকে দলছুট করা দরকার! নেকড়ে-রাখাল তাই আসল রাখাল-এর মত হুস-হাস আওয়াজ করে ভেড়াগুলোকে এদিক ওদিক ভাগানোর তাল করল। তাতে লাভ হল এই – গলা দিয়ে নেকড়ের হাউ-হাউ বেরিয়ে এল। ব্যাস, রাখাল গেল জেগে। পিটুনির চোটে নেকড়ে শেষ।
নীতিশিক্ষাঃ ছদ্মবেশ ধরে কাজ করতে গেলে বাড়াবাড়ি হয়ে যাবেই (আর সব পণ্ড হবে)
আমি আরো বলিঃ মুখ খুলতে দিলেই ধরা পরবে কার ছাল গায়ে কে এসেছে।

(২)The Stag at the Pool
জলের ধারের শিঙেল হরিণ
মাঠের ধারে দিঘীর জলে নিজের ছায়ায় বাহারী শিং-এর রূপ দেখে দেখে এক শিঙেল হরিণ একেবারে মুগ্ধ। কিন্তু মেজাজ খিঁচড়ে দিল তার কুচ্ছিৎ দেখতে কাঠি কাঠি পা-গুলো। এমন সময় এক সিংহ এসে হাজির সেই জলের ধারে। হরিণ তখন একটু আগে দুচ্ছাই করা ঐ পাগুলোরই ভরসায় দে দৌড়, দে দৌড়। বেঁচে গিয়েওছিল প্রায়। মারা পড়ল জঙ্গলে ঢুকে গাছপালায় শিং জড়িয়ে গিয়ে। সিংহের হাতে মরতে মরতে হরিণ আফশোষ করল – “কী হতভাগা আমি! বুদ্ধুর বুদ্ধু! যে পাগুলো আমায় বাঁচাতে পারত সেগুলোকেই গাল পাড়ছিলাম, আর যে শিংগুলো নিয়ে এত গর্ব করছিলাম সেগুলোর জন্যই শেষে মারা পড়লাম।”
নীতিশিক্ষাঃ আসলেই যা দামী, প্রায়ই তার ঠিকমত কদর হয় না।
আমি আরো বলিঃ অহংকারীরা তাদের দুর্বলতার হদিশ পায় না বলেই তাদের পেড়ে ফেলা যায়।

(৩)The Fox and the Mask
শেয়াল ও মুখোশ
এক শেয়াল একবার এক নাটুয়ার বাড়ি ঢুকে পড়ল। মাল-পত্তর ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে পেয়ে গেল একটা মুখোশ। মানুষের মুখের এক চমৎকার নকল। শেয়ালটা থাবা দিয়ে ঐ মুখোশ নাড়াচাড়া করতে করতে বলে উঠল – “কি সুন্দর মাথা একটা। কিন্তু কোন দাম নেই এর কারণ এটার ভিতরে এক ছটাকও মগজ নেই। ”
নীতিশিক্ষাঃ বুদ্ধি ছাড়া সুন্দর মুখের দাম সামান্যই।
আমি আরো বলিঃ শিল্পের দাম বুঝলে শেয়াল তো মানুষ-ই হয়ে যেত!
(৪)The Bear and the Fox
ভালুক আর শেয়াল
এক ভালুক-এর খুব ইচ্ছা সবাইকে জানায় কি বিরাট পরোপকারী আর দয়ালু স্বভাব তার। এই নিয়ে বক্তালি করতে গিয়ে সে জানাল যে সমস্ত পশুপাখীর মধ্যে সে-ই মানুষকে সবার চেয়ে বেশী সম্মান দ্যায় কারণ সে কখন-ও কোন মরা মানুষ নিয়ে টানাটানি করে না।
এক শেয়াল সে সব শুনে মুচকি হেসে ভালুকটাকে বলে, “হুঁঃ! সবসময় জ্যান্ত মানুষ খাওয়ার বদলে তুমি যদি মরা মানুষ খেতে সেটাই বরং তাদের পক্ষে ভাল হত।”
নীতিশিক্ষাঃ না মরলে দ্যায় না, অমন সম্মান দেওয়ার কোন মানে হয় না।
আমি আরো বলিঃ শিয়ালের উস্কানিতে মরা সেজেও আর ভালুকের হাত থেকে বাঁচা যাবে না!

(৫)The Wolf and the Lamb
নেকড়ে ও ভেড়ার গল্প
ঘুরতে ঘুরতে এক নেকড়ে একটা দলছুট ভেড়াকে একলা পেয়ে গেল। নেকড়ের ইচ্ছে হল বেশ মহত্ব দেখায়। ভেড়াটার উপর কোন হামলা না চালিয়ে বরং কিছু যুক্তি-তক্ক দিয়ে সেটাকে বুঝিয়ে দেওয়া যাক যে ভেড়াটাকে খাওয়ার ব্যাপারটা নেকড়ের হক-এর মধ্যেই পড়ে। সে ভেড়াটাকে বলল
“এই যে মশায়, গেল সনে আপনি আমাকে বিস্তর অপমান করেছিলেন।”
ভেড়াটা ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল “কিন্তু, আমার তো গত বছর জন্মই হয়নি!”
নেকড়েটা তখন বলে, “হতে পারে। কিন্তু, আমার মাঠের ঘাস খাও তুমি”
“না হুজুর,” ভেড়া উত্তর দ্যায়, “ঘাস খেতে কেমন তাই আমি জানি না এখনো।”
নেকড়ে ছাড়ে না, “তুই আমার কুয়ো থেকে জল খাস। ”
“না, না,” আর্তনাদ করে ওঠে ভেড়াটা, “আমি এখনো এক ফোঁটা জল ও মুখে দিইনি। আমি ত এখনো শুধু মা’র দুধ খাই! ”
“হুম! আমার সব অভিযোগ-এর তুই ভালই জবাব দিয়ে দিয়েছিস। কিন্তু, তা বললে তো আর আমার পেট চলবে না।” এই বলতে বলতেই ভেড়াটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শয়তান নেকড়ে তাকে টুকরো টুকরো করে খেয়ে ফেলল।
নীতিশিক্ষাঃ অত্যাচারী সবসময়ই অত্যাচার করার জন্য কিছু না কিছু কারণ খুঁজে বার করে ফেলে।
আমি আরো বলিঃ যারা কোন কথা শুনবে না ঠিক করেই রেখেছে, তাদের সাথে যুক্তি-তর্কে গিয়ে ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই।


ঈশপের গল্প (৬ – ১০)

৬)The One-Eyed Doe
এক চোখ-নষ্ট হরিণ-এর গল্প
এক হরিণ-এর একটা চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। দেখতে না পাওয়া বিপদ-এর হাত থেকে বাঁচতে সে সমুদ্রের ধারের মাঠে ঘাস খেয়ে বেড়াত। তার ভাল চোখটা সে ফিরিয়ে রাখত ডাঙ্গার দিকে যাতে কোন শিকারী বা শিকার ধরা কুকুর এলে দূর থেকেই তাকে দেখতে পেয়ে যায়। সমুদ্রের দিক থেকে সে কোন বিপদের ভয় করত না। তাই তার নষ্ট চোখটা সে ঐ দিকে রেখে রেখে চরে বেড়াত। একদিন সমুদ্রে সেই এলাকা দিয়ে নৌকা বেয়ে যাচ্ছিল কিছু লোক। তারা হরিণটাকে দেখতে পেয়ে অনায়াসে তাক করে তাকে মেরে ফেলল।
মরার সময় হরিণটা বলে গেল, “কি দুর্ভাগা আমি! ডাঙ্গার দিক থেকে যাতে বিপদে না পড়ি তার জন্য কত ব্যবস্থা নিলাম, এমনকি এই সাগরের ধারে চলে এলাম, ভেবেছিলাম বেঁচে গেলাম, উল্টে আরো সহজে মারা পড়লাম।”
প্রাচীন বচনঃ যে দিক থেকে সবচেয়ে কম সন্দেহ করা যায়, অনেক সময় সেদিক থেকেই বিপদ ঘনিয়ে আসে।
আমি বলিঃ অন্ধ বিশ্বাস পতন ঘটায়। যুক্তি দিয়ে সবসময় সবদিকে নজরদারী জারী রাখতে লাগে।

(৭)The Dog, Cock and Fox
কুকুর, মোরগ আর শিয়াল-এর গল্প
এক কুকুর আর তার সাথী এক মোরগ। দু’জনে মিলে ঘুরতে বেড়িয়েছিল। ঘুরতে ঘুরতে রাত হয়ে গেল। তখন তারা আশ্রয়ের জন্য ঘন বনের মধ্যে চলে এল। মোরগ চড়ে বসল এক গাছের অনেক উঁচু একটা ডালে আর কুকুর সেই গাছের নীচে তার বিছানা পেতে নিল। ভোর হলে, যেমন সে রোজ করে, মোরগ ডেকে উঠল কোঁকড়-কো করে। সেই আওয়াজ শুনে এক শিয়ালের মনে হল সকালের নাস্তাটা আজ মোরগের মাংসে সেরে ফেললে খাসা হয়। শিয়াল তখন ঐ ডালটার নীচে চলে এল আর নানাভাবে মোরগের মিষ্টি গলার আওয়াজের সুখ্যাতি করে তার সাথে দোস্তি পাতাতে চাইল।
“আপনি রাজী থাকলে,” বলল সে মোরগকে, “আজকের দিনটা আপনার সাথে কাটাতে পারলে আমার খুব ভাল লাগবে।”
মোরগ বলল, “মশায়, এক কাজ করেন, একটু এগিয়ে এই গাছের গোড়ায় চলে যান। আমার মালপত্র যে টানে সে ঐখানে ঘুমিয়ে আছে। তারে ডেকে তোলেন, সে আপনাকে এখানে আসার জন্য দরজা খুলে দিবে।”
শিয়ালকে ঐদিকে আসতে দেখেই কুকুর একেবারে লাফ দিয়ে উঠল আর শিয়ালের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলল।
প্রাচীন বচনঃ অন্যদের যারা ফাঁদে ফেলতে চায়, প্রায়ই তারা নিজেরাই নিজেদের ফাঁদে পড়ে যায়।
আমি বলিঃ চেনা শয়তান যখন ভাল কথা বলে মন ভোলায়, জেনে রেখো সে তোমায় ডোবানোর ফন্দী আঁটছে।
(৮)The Mouse, the Frog, and the Hawk
ইঁদুর, ব্যাঙ, আর বাজপাখীর গল্প
এক ইঁদুর, এমনই কপাল খারাপ তার, এক ব্যাঙ-এর সাথে জিগরী দোস্তি পাতিয়ে বসল। ব্যাঙটা একদিন, মাথায় নষ্টামি বুদ্ধি চাপলে যা হয়, ইঁদুরটার এক পায়ের সাথে নিজের এক পা আচ্ছা করে বেঁধে ফেলল। তারপর টানতে টানতে তাকে নিয়ে চলল সে নিজে যেই পুকুরে থাকত সেখানে। পুকুর-পাড়ে পৌঁছে, হঠাৎ সে ঝপাং করে দিল লাফ, ইঁদুর-সুদ্ধ সোজা জলে গিয়ে পড়ল। জলে পড়ে সেই ব্যাঙের সে কি মাতামাতি! সাঁতরাচ্ছে, ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর করে ডাকাডাকি করছে, যেন এক বিরাট কাজ করে ফেলেছে সে। ইঁদুরটা কি কষ্ট যে পেল! খানিকক্ষনের মধ্যেই জলে ডুবে, দম আটকে মারা গেল বেচারা। তার শরীরটা জলে ভাসতে থাকল। তখনো ব্যাঙের পা-এর সাথে তার পা বাঁধা। উড়তে উড়তে এক বাজপাখীর নজরে পড়ল সেই জলে-ভাসা ইঁদুর। ছোঁ মেরে নেমে এসে ইঁদুরটা নিয়ে সে উঠে গেল ঐ-ই-ই উঁচুতে। ইঁদুরের পায়ে পা বাঁধা থাকায় সেই ব্যাঙ-ও তখন বাজ-এর থাবায় বন্দী। এর পর ইঁদুরের সাথে সাথে ব্যাঙটা-ও চলে গেল বাজ-এর পেটে।
প্রাচীন বচনঃ যেমন কাজ তার তেমন ফল।
আমি বলিঃ যে পাজী সে হয়ত ছাড়া পাবে না, কিন্তু তার হাতে নিজেকে ছেড়ে দ্যায় যে হতভাগা সে মারা পড়বে সবার আগে।

(৯)The Dog and the Oyster
এক কুকুর আর ঝিনুক-এর গল্প
এক কুকুর খুব ডিম খেতে ভালবাসত। একদিন সে একটা অয়স্টার বা দুই-খোলের ঝিনুক কুড়িয়ে পায়। ঝিনুকটাকে ডিম ভেবে মুখখানা এত্তবড় হাঁ করে সে ওটাকে গিলে ফেলল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভয়ানক পেটের যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে সে আর্তনাদ করতে থাকে, “এমন বুদ্ধু আমি, গোল দেখলেই ভাবি ডিম, আমার এইরকম চরম কষ্টই পাওয়া উচিত।”
প্রাচীন বচনঃ হড়বড়িয়ে কাজ করে, পস্তাতে হয় পরে পরে।
আমি বলিঃ হড়বড়াং – চিৎপটাং – মন্তব্য লাফাং – ডুপ্লি ঘ্যাচাং – কপাল চাপ্রাং – ঠাং-ঠাং-ঠাং

(১০)The Wolf and the Shepherds
এক নেকড়ে আর ভেড়া চড়ানো রাখালেরা
রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল এক নেকড়ে। একটা বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সে দেখে বাড়ির মধ্যে ভেড়া চড়ানো রাখালের দল রাতের খাবার সারছে গাদা গাদা মাংস দিয়ে। নেকড়েটা তাই দেখে সেই রাখালদের ডেকে বলল, “এই কাজটাই যদি আমি করতাম, চ্যাঁচামেচি করে তোমরা দুনিয়া মাথায় তুলে ফেলতে।”
প্রাচীন বচনঃ লোকেরা নিজেরা যা করে সেটাই অন্য কেউ করলে তখন তাকে দোষ দিতে থাকে।
আমি বলিঃ নিজের বিশ্বাসটাই শুধু ঠিক বলে যারা জাহির করে, তারাই অন্য লোকেরা একই রকম করলে সেই লোকেদের মুখ বন্ধ করে দিতে চায়।

-(১১-১৫)




ঈশপের নীতিগল্পগুলি পড়েছি অনেক ছোটবেলায়। যত বড় হয়েছি, গল্পগুলি তত বেশী করে অনুভব করেছি। সম্প্রতি ইচ্ছে হ’ল সে’গুলি ফিরে পড়ার, ধরে রাখার – নিজের মত করে ।
ইংরেজী পাঠের অনুসারী বঙ্গানুবাদ, আক্ষরিক নয়। সাথে আমার দু-এক কথা।
(১১)The Hares and the Frogs
খরগোশ-এর দল আর ব্যাঙ-দের গল্প
খরগোশদের সবকিছুতে এত ভয় করে! আর সেই কবে থেকে যে তারা জেনে গেছিল – সবসময় হুঁশিয়ার হয়ে থাকতে হবে তাদের! একসময় খুব দুঃখ হল তাদের, আর সহ্য হয়না এ যন্ত্রণা। এক ধাক্কায় এবার সব মিটিয়ে ফেলা দরকার, একটা হু-ই-ই উঁচু খাড়াই পাহাড় থেকে নীচের হ্রদের গহীন জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সব শেষ করে দিলেই পরম শান্তি। দলে দলে হ্রদের দিকে চলল তারা। তাদের এত এত পায়ের আওয়াজে জলের ধারে সার দিয়ে বসে থাকা ব্যাঙদের মনে ভীষন ভয় ধরে গেল। বাঁচবার জন্য হুড়মুড় করে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে তারা ডুব লাগাল গভীর জলের নীচে। ব্যাঙেদের এইভাবে দুদ্দাড় করে হাওয়া হয়ে যেতে দেখে, খরগোশদের একজন বলে উঠল, “আরে দাঁড়াও, দাঁড়াও দোস্তোরা সব, বাদ দাও যা করতে যাচ্ছিলে, দেখতেই পাচ্ছ, আমাদের থেকেও অনেক ভীতুরা দিব্যি বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে।”
প্রাচীন বচনঃ আমাদের থেকেও যারা অসহায় অবস্থায় আছে তাদের দেখলে নিজেদের উপর আস্থা জেগে ওঠে।
আমি বলিঃ পালিয়ে যাওয়া ছাড়া যারা বাঁচতে জানে না, সামান্যতম আশঙ্কাতেই তারা লাফিয়ে পালিয়ে যাবে। একবার থেমে দেখবেও না ঘটনাটা কি! কি হবে তাদের দিয়ে!
(১২)The Lion and the Boar
সিংহ আর শুয়োরের গল্প
এক গ্রীষ্মের দিন। ভয়ানক গরমের চোটে তেষ্টায় সবার অবস্থা কাহিল। এক সিংহ আর এক শুয়োর এক সাথে এসে হাজির ছোট এক কূয়োর ধারে। কে আগে জল খাবে এই নিয়ে দুজনের মধ্যে লেগে গেল তুমুল ঝগড়া। তারপর সেই ঝগড়া থেকে শুরু হল মারামারি, মরণপণ – প্রাণ থাকতে অন্যজনকে আগে জল খেতে দেবে না। লড়তে লড়তে একসময় দুজনেই একটু থেমেছে, দম নিয়ে নিতে – আরো ভয়ংকর হিংস্র লড়াই লড়ার জন্য। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে একটু তফাতে সার দিয়ে বসে আছে – শকুনেরা, ভূরিভোজের অপেক্ষায়। অচল হয়ে যেই একজন শুয়ে পড়বে, সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়বে তার উপরে। এই দেখে দুজনেই সঙ্গে সঙ্গে তাদের যুদ্ধ থামিয়ে দিল, বললঃ “আমাদের বরং দোস্তি করে নেওয়াই ভাল। না হলে তো কাক শকুনের খাদ্য হতে হবে, স্রেফ আমাদের দম ফুরিয়ে পড়ে যাওয়ার অপেক্ষা।”
প্রাচীন বচনঃ একদল যখন লড়াই করে আরেকদল তখন তাদের উপর নজর রাখে, লড়িয়েদের কেউ একজন হেরে গেলেই তার হার থেকে তারা তখন নিজেদের ফায়দা তুলবে।
আমি বলিঃ এযুগের ধান্দাবাজ শকুনেরা আর শুধুই দর্শক নয়, তারাই লড়াইগুলোর আয়োজন করে। ধর্মের নামে, ইজ্মের নামে, দলের নামে, শতেক অজুহাতে, তারাই আমজনতাকে লড়িয়ে দ্যায় পরস্পরের বিরুদ্ধে। তারপর ফায়দা তোলে সকলের দুরবস্থা থেকে।
(১৩)The Mischievous Dog
নচ্ছার কুকুরের গল্প
এক কুকুর লোকজন দেখলে চুপচাপ তাদের দিকে তেড়ে যেত, তারপর তারা কিছু টের পাওয়ার আগেই তাদের গোড়ালিতে কামড় বসাত। কুকুরটার মালিক মাঝে মাঝে তার গলায় একটা ঘন্টা বেঁধে দিত যাতে সে কোথাও গেলে চারপাশের সবাইকে জানিয়ে দিতে বাধ্য হয় যে সে এসে গেছে। আবার মাঝে মাঝে তার গলায় একটা শিকল বেঁধে সেই শিকলে একটা ওজনদার ভার ঝুলিয়ে দিত যাতে সে লোকজনকে কামড়ানোর জন্য ছুট লাগাতে না পারে।
কুকুরটা দিনে দিনে তার এই ঘন্টা আর ভার-টা নিয়ে খুব অহঙ্কারী হয়ে উঠল। ওগুলো নিয়ে সেই বাজার এলাকার সব জায়গায় সে দেখিয়ে বেড়াত। তখন এক বুড়ো শিকারী কুকুর একদিন তাকে ডেকে বলল, “এত নিজেকে দেখিয়ে বেড়ানোর কি হয়েছে তোর? যে ঘন্টা আর ভার-টা ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াস, সেগুলো কোন সম্মান-পদক নয়, বরং, অপমানের চিহ্ন। সব্বাইকে জানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা যে তুই একটা নচ্ছার স্বভাবের কুকুর।”
প্রাচীন বচনঃ কোনভাবে তাকে নিয়ে কথা হলেই অনেকে সেটাকে সুখ্যাতি ভেবে ভুল করে বসে।
আমি বলিঃ দেশের সেবার নামে মাস্তানি করে আহাম্মকেরা ভাবে লোকেরা তাদের মাথায় করে রেখেছে। পরের ভোটে হারার আগে বোঝেনা লোকেরা আসলে তাদের কি চোখে দেখছে।
(১৪)The Quack Frog
এক হাতুড়ে-ডাক্তার ব্যাঙ-এর গল্প
এক ব্যাঙ একদিন বনের সব জন্তু-জানোয়ারদের ডেকে জানিয়ে দিল যে সে সবার সব রোগ সারিয়ে দিতে পারে। এক শিয়াল তখন তাকে জিজ্ঞেস করল, “সকলের জন্য নিদান দেওয়ার ভান কর কি করে হে? নিজের খোঁড়াদের মত লাফিয়ে চলা আর কুঁচকানো চামড়া-টাই তো তুমি সারাতে পার না?”
প্রাচীন বচনঃ অন্যের স্বভাব শোধরানোর আগে নিজেকে শোধরালে লোকের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ে।
আমি বলিঃ ঠিকমত চেপে না ধরা পর্যন্ত সব-জান্তা ভন্ডরা দিব্যি তাদের লোক-ঠকান ব্যাবসা চালিয়ে যেতে থাকে।
(১৫)The Ass the Fox, and the Lion
গাধা, শিয়াল আর সিংহের গল্প
এক গাধা আর এক শিয়াল জোট বাঁধল যে তারা একসাথে খাবার জোগাড় করবে। বনে ঢুকতেই তারা দেখে এক সিংহ আসছে। শিয়াল তাড়াতাড়ি সিংহের কাছে গিয়ে তাকে কথা দিল যে সিংহ যদি শিয়াল-কে না মারে তবে সে গাধাকে তার হাতে তুলে দেবে। সিংহ রাজী হয়ে গেল – শিয়ালের কোন ক্ষতি সে করবে না। শিয়াল তখন গাধাকে পথ দেখানোর ছল করে এক গভীর গর্তে নিয়ে গিয়ে ফেলল। সিংহ যেই দেখল যে গাধার ব্যবস্থা হয়ে গেছে তখন প্রথমেই থাবা মেরে শিয়ালটাকে খেল, আর তারপর ধীরেসুস্থে সময় নিয়ে গাধাটাকে ধরল।
প্রাচীন বচনঃ বিশ্বাসঘাতকের কপালে বেইমানি-ই জোটে।
আমি বলিঃ সময় থাকতে বেইমানদের মুখোশ খুলে তাদের থেকে সরতে না পারলে নিজের ধ্বংস অনিবার্য।

১৬-২০



(১৬)The Wolf and the Sheep
নেকড়ে আর ভেড়ার গল্প
এক নেকড়ের একদিন খুব শরীর খারাপ করেছে, নড়তে-চড়তে পারছে না। ব্সে থাকতে থাকতে একসময় দেখে এক ভেড়া যাচ্ছে সেখান দিয়ে। নেকড়েটা তাকে ডেকে কাছের ঝর্ণা থেকে জল এনে দেওয়ার অনুরোধ জানালো। “জল এনে দিলেই হবে,” ভেড়াটাকে বলল সে, “মাংসের যোগাড়টা আমি নিজেই করে নিতে পারব।” “হ্যাঁ, তার আর সন্দেহ কি,” ভেড়া শুনে বলে, “আমি তোমায় একটি আঁজলা জল এনে দিলেই হবে। তার পরে এই আমাকে দিয়েই মাংস জোগাড় করার কাজটাও তোমার এমনিই হয়ে যাবে।”
প্রাচীন বচনঃ ধোঁকাবাজী কথা সহজেই ধরা পড়ে যায়।
আমি বলিঃ তোমাকে মেরে যার লাভ আছে, সে যখন নিরীহ কথা বলে কাছে ডাকে, নিশ্চিত জেনো সেটা ফাঁদ, একবার বিশ্বাস করেছ কি মরেছ।
(১৭)The Cock and the Jewel
এক মোরগ আর একটা খুব দামী মণি
এক মোরগ খাবার খুঁজছিল। নিজে খেতে হবে, বাচ্ছাদেরও খাওয়াতে হবে। এখানে ওখানে খোঁজাখুঁজি করতে করতে হঠাৎ তার নজরে আসে বাহারী এক মণি – অত্যন্ত দামী। মণিটা দেখে মোরগ বলল, “ মণি রে, আমার বদলে তোর মালিক যদি তোকে এখন পেত, আদর করে তুলে নিত তোকে, সাজিয়ে রাখত তোকে কত মর্যাদা দিয়ে। কিন্তু আমার কাছে তোর কোন দাম-ই নেই। দুনিয়ার সমস্ত মণি এনে দিলেও আমি বরঞ্চ চাইব একটা শস্যের দানা।”
প্রাচীন বচনঃ একটা অতি দামী জিনিষ ও তার কাছে অর্থহীন যে লোক সেটাকে কোন কাজে লাগাচ্ছে না।
আমি বলিঃ বিশ্বাসে নির্ভর করেই যারা চলবে ঠিক করেছে, যুক্তি-তর্কের মহাজ্ঞানে তাদের কিছু যায়-আসে না।
(১৮)The Two Pots
দুই কলসীর গল্প
নদীতে ভাসতে ভাসতে চলেছে দুই কলসী। এক কলসী মাটির, এক কলসী পিতলের। স্রোতের টানে ভেসে যেতে যেতে মাটির কলসী পিতলের কলসীকে বলে, “প্রার্থনা করি রে ভাই, দূরে দূরে থাক, আমার দিকে আসিস না তুই। আলতো করেও যদি একবার ছুঁয়ে ফেলিস আমায়, টুকরো টুকরো হয়ে যাব আমি; আর আমার কথা যদি বলিস, তোর ধারে কাছে যাওয়ার কোন ইচ্ছা নেই আমার।”
প্রাচীন বচনঃ ঠিক ঠিক বন্ধুত্ব হয় শুধু সমানে সমানে।
আমি বলিঃ যে মহাজন সুদ দ্যান, তিনি যত-ই চিকন-চাকন হন, তারে দূরে রাখাই ভাল। তার সাথে ‘তুমিও মালিক, আমিও মালিক’ এই বেরাদরীতে গেলে আখেরে পস্তাতে হবে।
(১৯)The gnat and the Lion
এক ডাঁশ আর এক সিংহ
এক ডাঁশ এক সিংহের কাছে এসে খুব কষে তড়পাল ঃ “শোন রে সিংহ, আমি তোকে একটুও ভয় পাই না, আর তুই আমার থেকে কিছুই শক্তিশালী নোস। তোর জোরটাই বা কিসে? আঁচড়াতে পারিস নোখ দিয়ে, কামড়াতে পারিস দাঁত দিয়ে – কি এল গেল তাতে? আবার ও বলছি, শুনে রাখ, সব দিক ভেবে দেখলে আমার জোর তোর থেকে অনেক বেশী। কোন সন্দেহ থাকলে, আয়, লড়ে যা, দেখি কে জেতে।” এই বলে, সেই ডাঁশ ভোঁ ভোঁ আওয়াজ করে, ঝাঁপিয়ে পড়ল সিংহের উপরে আর একেবারে তার নাকের ডগায় দিল হুল ফুটিয়ে। সিংহ ডাঁশটাকে থাবার থাবায় মেরে ফেলতে গিয়ে নিজের-ই নখ-এ নিজেকে ক্ষত-বিক্ষত করে ভীষণ রকম কাহিল হয়ে পড়ল। ডাঁশ এইভাবে সিংহের সাথে যুদ্ধ জিতে ফেলে গোঁ গোঁ করে বিজয়-সঙ্গীত গাইতে গাইতে উড়ে চলে গেল। কিন্তু বেশীদূর যাওয়া হল না তার, সোজা গিয়ে জড়িয়ে গেল কাছাকাছি এক মাকড়সার জালে। খানিকক্ষণের পরে, চলে গেল মাকড়সার পেটে। মরার সময় ডাঁশটা খুব করে নিজের ভাগ্যকে শাপশাপান্ত করে বলে গেল, “কি দুঃখের কথা, আমি, সিংহের মত একটা মহা শক্তিশালী জন্তুকে যে অনায়াসে হারিয়ে দিয়ে এল, একটা তুচ্ছ মাকড়সাটার কাছে শেষ হয়ে গেলাম।”
প্রাচীন বচনঃ সবচেয়ে কম যাকে ভয় করা যায়, সেই দেখা যায় সবার চেয়ে বেশী ভয়ংকর হয়ে উঠল।
আমি বলিঃ একটা লড়াই জিতলেই যদি কান্ডজ্ঞান লোপ পেয়ে যায়, বাকি লড়াইগুলো আর তা হলে জিততে হবে না।
(টীকাঃ ডাঁশ = মশা জাতীয় পতঙ্গ, হুল ফুটিয়ে অবস্থা কাহিল করে ফেলে)
(২০)The Widow and her Little Maidens
এক বিধবা আর তার ছোট ছোট দুই কাজের মেয়ে
এক বিধবা মহিলার মহা বাতিক ছিল সবকিছু পরিস্কার করে রাখার। দুটি ছোট ছোট মেয়েকে সে লাগিয়ে নিয়েছিল তার কাজে। খুব খাটাত সে মেয়েগুলোকে। ভোরবেলা মোরগের কোঁকর কোঁ ডাক শোনা গেলেই সে তাদের কাজ করার জন্য ঠেলে তুলে দিত। জেরবার হয়ে গিয়ে মেয়েদুটো একদিন ঠিক করল যে মোরগটাকে শেষ করে দিলেই ওটা আর তাদের মালকিনকে জাগাতে পারবে না। যেমন ভাবা তেমন কাজ – মেরে ফেলল তারা মোরগটাকে। ফল হল এই, এবার তারা আরো মুস্কিলে পড়ে গেল। মোরগের ডাক না শুনতে পাওয়ায় তাদের মালকিন এখন সময়ের আর কোন হিসেব-ই করে উঠতে পারল না। মাঝরাত্তিরেই সে তাদের ঠেলে তুলে দিয়ে কাজ করতে লাগিয়ে দিল।
প্রাচীন বচনঃ অন্যায্য উপায়ে কাজ-এর চাপ কমাতে গেলে ঝামেলা আরো বেরে যায়।
আমি বলিঃ অসহায় যারা তারা পিষ্ট হতে হতে একসময় কোন একটা ভুল করে ফেলবে। ফলে, তখন তারা আরো বেশী করে পিষ্ট হবে। আর, নীতিনির্ধারকেরা তাদের উদাহরণ তুলে ধরে বলবে – দ্যাখো, অন্যায্য কাজ করে আখেরে লাভ হয় না। হায় রে বিচার!

২১-২৫


(২১)The Fox and the Lion
শিয়াল আর সিংহ-র গল্প
বনে ঘুরতে ঘুরতে এক শিয়াল হঠাৎ এক সিংহের মুখোমুখি এসে পড়ল। এর আগে সে কখনো সিংহ দেখেনি। ফলে সে ত ভয়েই মরে প্রায়! তার কিছুদিন বাদে আবার সেই সিংহের সাথে দেখা সেই শিয়ালের। এইবার-ও শিয়াল ভয়ে ভয়ে ছিল, তবে প্রথমবারের মত অতটা নয়। তিন নম্বর বার যখন দেখা হল, শিয়ালের আর ভয় ত করলইনা, সে বরং সিংহের কাছে এগিয়ে গিয়ে গল্প জুড়ে দিল।
প্রাচীন বচনঃ পরিচিতি বাড়লে পুরান সংস্কার কমে।
আমি বলিঃ চালাক শক্তিমান একেবারে শুরু থেকেই হামলা করার ইচ্ছে না দেখিয়ে আস্তে, আস্তে তার শিকার-এর সতর্কতা নষ্ট করে দ্যায়।
(২২)The Town Mouse and the Country Mouse
শহরের ইঁদুর আর গাঁয়ের ইঁদুর
এক গাঁয়ের ইঁদুর তার জিগরী দোস্ত শহরের ইঁদুরকে বাড়িতে ডেকেছিল নিজের এলাকা ঘুরিয়ে দেখাবে বলে। যখন তারা ফাঁকা ক্ষেতে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, আর ঝোপের ধারে ধারে ফসলের ডাঁটি চিবোচ্ছিল বা মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে শেকড়গুলো খাচ্ছিল, শহরের ইঁদুর তার বন্ধুকে বলল “পিঁপড়ের মত খুঁটে খেয়ে খেয়ে তোর জীবন কাটে আর, আমার ওখানে জিনিসের ছড়াছড়ি। যত রকমের খাবার ভাবতে পারিস, সব আছে আমার কাছে। একবার যদি আসতে পারতিস, দেখাতাম তোকে, আয়, আয়, চলে আয়, সেরার সেরা খাবার ভাগাভাগি করে খাব আমরা।” গাঁয়ের ইঁদুর সহজেই রাজী হয়ে গেল, বন্ধুর সাথে শহরে বন্ধুর বাড়িতে চলে এল। শহরের ইঁদুর বন্ধুর সামনে এনে হাজির করল রুটি, বার্লি, বীন, শুকনো ডুমুর, মধু, কিসমিস, আর সবশেষে একটা ঝুড়ি থেকে, সেরার সেরা সুস্বাদু খাবার – এক টুকরো চীজ। এত রকমারী সব খাবার দেখে, গাঁয়ের ইঁদুর তো তাজ্জব! সমানে শহরের ইঁদুর-কে বাহবা জানাতে লাগল আর নিজের দুর্ভাগ্যকে দোষ দিতে থাকল। সবে তারা খাওয়া শুরু করতে যাচ্ছে, ঘরের দরজা খুলে একটা লোক ভিতরে ঢুকে এল, আর দুই ইঁদুর এক দৌড়ে এক সরু গর্তে একজন আরেকজনের ঘাড়ের উপর চেপে কোনমতে নিজেদের লুকিয়ে রাখল। একটু বাদে ঠিক যখন আবার তারা খাওয়া শুরু করবে, কেউ একজন ঘরে এসে পড়ল কাবার্ড থেকে কিছু বার করে নেবে বলে। ইঁদুর দুটো আরো ভয় পেয়ে পড়ি-মরি করে লুকিয়ে পড়ল। খানিকক্ষণ বাদে, গাঁয়ের ইঁদুর, তখনো তার বুক ধড়ফড় করছে, বন্ধুকে বলল, “যদিও আমার জন্য সেরার সেরা খাবারের মেলা বসিয়ে দিয়েছ তুমি, আমি সব খাবার তোমার একলার খাওয়ার জন্যই রেখে যাচ্ছি। আনন্দ করার জন্য আমার পক্ষে এই জায়গা বড়ই বিপজ্জনক। ”
প্রাচীন বচনঃ বিপদ-আপদ-এ ঘেরা বিপুল ঐশ্বর্যের চেয়ে নিরাপদে একটু খুদ-কুঁড়ো খাওয়াও অনেক স্বস্তির। (সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল।)
আমি বলিঃ মাথা উঁচু রেখে চলা যাদের অভ্যাস, লুকিয়ে-চুরিয়ে বাঁচা, যত কিছুই জুটুক, তাদের তাতে পোষায় না।
(২৩)The Monkey and the Dolphin
বাঁদর আর শুশুক-এর গল্প
এক নাবিক দূর সমুদ্র যাত্রায় যাওয়ার সময় মাঝে মাঝে বাঁদরের খেলা দেখে একঘেয়েমি কাটানোর জন্য একটা বাঁদরকে সাথে নিয়ে নিয়েছিল। গ্রীসের সমুদ্রতীরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভীষণ ঝড়ে পরে তাদের জাহাজ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। সেই নাবিক, তার বাঁদর আর জাহাজের সমস্ত লোকেরা যার যার প্রাণ বাঁচানোর জন্য ডাঙ্গার দিকে সাঁতরে চলল। একটি শুশুক, যে সব সময় মানুষকে সাহায্য করতে ভালবাসে, এদের বাঁচাতে এগিয়ে এল। বাঁদরটাকে মানুষ ভেবে সেই শুশুক ঐ বাঁদর-এর নীচে চলে এসে তাকে পিঠে করে ডাঙ্গার দিকে সাঁতরে চলল। যখন তারা এথেন্স এর তীরের কাছাকাছি এসে গেছে, শুশুক তার পিঠের সওয়ারীর কাছে জানতে চাইল যে সে এথেন্স-এর লোক কি না। বাঁদর বলল যে, সে এথেন্স-এর লোক, শুধু তাই না, সে এথেন্স-এর সবচেয়ে মহান এক পরিবারে জন্মেছে।
শুশুক এবার তার কাছে জানতে চাইল সে পাইরিয়াস সম্পর্কে কিছু জানে কি না। পাইরিয়াস হচ্ছে এথেন্স-এর বিখ্যাত বন্দরের নাম। বাঁদর ভাবল পাইরিয়াস কোন লোকের নাম। নিজের একটু আগে বলা মিথ্যা কথাকে চালিয়ে যাওয়ার জন্য সে উত্তর দিল যে পাইরিয়াস-কে সে ভালমত চেনে, এমন কি, সেই লোক তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আর তাকে দেখে সে, কোন সন্দেহ নেই, খুব-ই খুশী হবে। বাঁদরের এই জালিয়াতি-তে সেই শুশুক সাংঘাতিক রেগে গিয়ে তাকে জলের নীচে চুবিয়ে মেরে ফেলল।
প্রাচীন বচনঃ একবার একটা মিথ্যা কথা বলা শুরু করলে সেটাকে ঢাকতে আর একটা, এইভাবে ক্রমাগত মিথ্যা বলে যেতে হয় আর তার ফলে, আজ হোক আর কাল হোক, একসময় বিপদ ঘনিয়ে আসে।
আমি বলিঃ অন্যের দয়ায় থেকে মিথ্যে বলেও বেশীদিন বাঁচা যায় না!
(২৪)The Game-cocks and the Partridge
লড়ুয়ে মোরগ আর বাতাই পাখীর গল্প
এক লোকের দুটো লড়ুয়ে-মোরগ ছিল। একদিন বাজারে একটা পোষা বাতাই পাখী বিক্রী হচ্ছিল। পাখীটা দেখে লোকটির এত ভাল লেগে গেল, সে ওটা কিনে বাড়ি নিয়ে এল। তার ইচ্ছে, মোরগ দুটোর সাথে থেকে এই পাখীটাও তৈরী হয়ে যায়। যেই মাত্র সে বাতাই-টাকে মোরগের খামারে ছেড়েছে, মোরগ দুটো ঝাঁপিয়ে এসে পড়ল ওটার উপর। দুটোতে মিলে পাখীটাকে ভয়ানক দৌড় করালো। মনের দুঃখে মুষড়ে পড়ে পাখীটা ভাবতে লাগল যে, সে নুতন এসেছে বলেই তার এমন দুর্দশা ঘটল। খানিকক্ষন না কাটতেই বাতাইটা দেখে মোরগ দুটো নিজেরাই তুমুল লড়াই লাগিয়ে দিয়েছে। যতক্ষণ না একজন আরেকজনকে ভীষণ রকম পিটল, লড়াই চালিয়েই গেল তারা। সেই দেখে পাখীটা নিজের মনেই বলল, “এই লড়ুয়ে-মোরগ দুটো যখন নিজেদের মধ্যেই ঝগড়া না করে থাকতে পারে না, তখন আমার সাথে কেন তারা লেগে পড়ল সেই নিয়ে ভেবে ভেবে হয়রান হওয়ার কোন অর্থ হয় না।”
প্রাচীন বচনঃ যারা নিজেদের মধ্যেই ঝগড়া করে, নুতন লোকেদের পক্ষে তাদের এড়িয়ে চলাই মঙ্গল।
আমি বলিঃ যারা নিজেরা নিজেদের দেখতে পারে না, তারা অন্য লোকেদের-ও দেখতে পারবে না।
(২৫)The Boy and the Nettle
এক বাচ্চা ছেলে আর বিছুটি পাতার গল্প।
একটি বাচ্চা ছেলের হাতে নরম কিন্তু বিষাক্ত শুঁয়ো-ওয়ালা বিছুটি পাতা লেগে যায়। বাচ্চাটি তার মা’র কাছে ছুটে গিয়ে বলে, “এত ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে, আমি কিন্তু ওটা আলতো করে ছুঁয়েছিলাম।” “সেটাই তো ব্যাপার,” মা তাকে বোঝায় তখন, “তার ফলেই তো রোঁয়াগুলো তোমার হাতে ঘষে ঘষে গেল আর সেগুলো থেকে হুল ফুটে গিয়ে এখন জ্বলে যাচ্ছে। আবার যদি কখনো বিছুটি পাতা ধরো, সাহস করে, ঠিক মত, শক্ত করে, না ঘষে ধরবে, ঐ রোঁয়াগুলো-ই তখন চুপটি করে নরম সিল্কের মত শুয়ে থাকবে, কোন ঝামেলা করবে না।”
(টীকাঃ ইংরেজীতে গাছটির নাম বলা হয়েছে Nettle, আন্তর্জালে অনেক খোঁজাখুঁজি করে বাংলা অনুবাদ-এ বিছুটি পাতার থেকে কাছাকাছি কিছু পাই নি। বিছুটি পাতা এইভাবে শক্ত করে ধরলে জ্বালা-চুলকানির কবলে পড়ার থেকে রেহাই পাওয়া যায় কি না আমার জানা নেই। )
প্রাচীন বচনঃ যা-ই করো, আলগা, আলগা নয়, পুরো শক্তি লাগিয়ে করো।
আমি বলিঃ আগে ভাল করে জেনে নাও কী করতে যাচ্ছ, কি ভাবে করতে হবে, তার পর করো, জ্বালা পোহানোর সম্ভাবনা কম থাকবে।
— — —
২৪ নং গল্পটিতে ইংরেজী অনুবাদে পাখীটিকে বলা হয়েছে Partridge. তারেক অণুর পাখীর নাম সংক্রান্ত লেখার ফলে জেনেছি যে এই পাখীর বাংলা নাম বাতাই। অণুর লেখাটি বাদ দিয়ে এই গল্পটি এ ভাবে অনুবাদ করা সম্ভব হত না।
অণু-দাদা, আজকের পাতাটা তোমার-ও পাতা।



ঈশপের গল্প (২৬ – ৩০)

ঈশপের নীতিগল্পগুলি, যত দিন যাচ্ছে, জীবনের চলার পথে আরো বেশী করে অনুভব করছি। সম্প্রতি ইচ্ছে হ’ল সে’গুলি ফিরে পড়ার, ধরে রাখার – নিজের মত করে।
অনুবাদ ইংরেজী পাঠের অনুসারী, আক্ষরিক নয়। সাথে আমার দু-এক কথা। 

[গল্পসূত্রঃ R. Worthington (DUKE Classics)-এর বই এবং আন্তর্জাল-এ লভ্য http://www.aesop-fable.com -এ ইংরেজী অনুবাদের ঈশপের গল্পগুলি।

গল্পক্রমঃ R. Worthington-এর বইয়ে যেমন আছে]
(২৬)The Trumpeter taken Prisoner
বন্দী ভেঁপু-বাজিয়ে
এক ভেঁপু-বাজিয়ে বুক-চিতিয়ে, জোরদার ভেঁপু বাজাতে বাজাতে সেনাদল নিয়ে যাওয়ার সময় শত্রুদের হাতে বন্দী হয়ে গেল। ভেঁপু-বাজিয়ে কেঁদে কেটে প্রাণভিক্ষা চাইলঃ “আমাকে দয়া করে ছেড়ে দিন। আমাকে ছেড়ে না দেওয়ার কোন কারণ নেই, আমি কাউকে আঘাত করিনি। আপনার সৈন্যদের কাউকে খুন করিনি আমি। আমার কাছে কোন অস্ত্র নেই। থাকবার মধ্যে আছে শুধু এই পিতলের ভেঁপুটা।” “ঠিক এই কারণেই তো তোকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া দরকার,” বলল তারা, “তুই নিজে যুদ্ধ না করলে কি হবে, তোর ঐ প্রবল ভেঁপুর বাজনাই তোদের সৈন্যদের যুদ্ধের উৎসাহ দিয়ে গেছে।”
প্রাচীন বচনঃ যে অশান্তি পাকায় আর যে অশান্তি পাকানোয় মদত দ্যায় দুজনেই সমান দোষী।
আমি বলিঃ কোন সংবাদ পত্রিকা, দূরদর্শন বা বেতার চ্যানেল, ব্লগ, গোষ্ঠী, দল বা ব্যক্তি, যে কেউ দাঙ্গায় প্ররোচনা দিলে দাঙ্গা-জনিত খুন বা ধ্বংসের দায়িত্ব দাঙ্গাকারীদের পাশাপাশি তাদের উপরেও বর্তায়।
সতর্কীকরণ ঃ মতামত মাত্রই খুন বা ধ্বংসের প্ররোচনা নয়। উপরে বলা দায়িত্ব সংক্রান্ত কথা কেবল মাত্র প্ররোচনা সম্পর্কে বলা হয়েছে।
(২৭)The Fatal Marriage
বিয়ে করে প্রাণ গেল
এক ইঁদুর খুব ভাল কাজ করে বনের রাজা সিংহ-র মন জয় করে ফেলল। তবে, সিংহ হচ্ছেন রাজামশায়। মহৎ কাজে বনের অন্য কোন জন্তু তাকে ছাড়িয়ে যাবে এটা তিনি হতে দিতে পারেন না। তাই তিনি অত্যন্ত উদার হয়ে ইঁদুরকে বললেন তার যা মন চায় তাকে জানাতে, তিনি তা মঞ্জুর করে দেবেন। এই বিরাট আশ্বাস পেয়ে ইঁদুরের উচ্চাশা একেবারে আগুনের শিখার মত লকলক করে উঠল। কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক, কতটা রাজামশাইয়ের পক্ষে দেওয়া সম্ভব, কতটা নয়, কোন বিচার-বিবেচনা রইলনা তার। সে দাবী করে বসল, মহারাজের মেয়ে তরুণী সিংহী রাজকুমারীর সাথে তার বিয়ে দিতে হবে। সিংহরাজ তার কথা রাখলেন, রাজকুমারীকে ইঁদুরের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু রাজকুমারী, সিংহের চলন তার, নিজের তালে হেঁটে যায়, এদিক-ওদিক ভাল করে তাকিয়ে না দেখে ইঁদুরের উপর তার ভারী পা দিল চাপিয়ে। আর কি, ইঁদুর চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে মরে গেল।
প্রাচীন বচনঃ বেমানান জোড় বাঁধা থেকে সাবধান। অতি উচ্চাশা নিয়ে জোট গড়া মানে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনা।
আমি বলিঃ খুব বড়দের থেকে দূরে দূরে থাকতে না পারলে যে কোন সময় তাদের নীচে চাপা পড়ে মরতে হতে পারে।
(২৮)The Ass and the Charger
এক গাধা আর এক লড়াইয়ের ঘোড়া।
এক লড়াইয়ের ঘোড়া খুব যত্ন-আত্তিতে ছিল। এক গাধা তাই দেখে তাকে খুব করে বাহবা জানাল কারণ তার নিজের খুব অল্প-ই খাবার জুটত, আর সেটাও জুটত অনেক পরিশ্রম করে। কিন্তু একদিন সেখানে যুদ্ধ শুরু হতে সেই ঘোড়ার পিঠে অস্ত্র-শস্ত্রে সুসজ্জিত সৈনিক সওয়ারী চাপিয়ে তাকে যুদ্ধে পাঠিয়ে দেওয়া হল। যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হয়ে ঘোড়াটা এক সময় মারা পড়ল। সব দেখে শুনে গাধা তার মত পাল্টে ফেলে বলল, “ঐ লড়াইয়ের ঘোড়ার থেকে আমি কত ভাগ্যবান! আমি নিশ্চিন্তে বাড়ি আছি, আর ঐ লড়াইয়ের ঘোড়া যুদ্ধের ভয়াবহ সব যন্ত্রণা ভোগ করে মারা পড়েছে।”
প্রাচীন বচনঃ অন্যের ভাল অবস্থা দেখামাত্র তাকে হিংসা করার কোন অর্থ হয় না।
আমি বলিঃ বেশী, বেশী যত্ন-আত্তির সুখ বেশীদিনের জন্য নয়, বিপদ এল বলে। আর, যার আদর আহ্লাদ জোটে না, তার অতিরিক্ত কোন মাসুল গোণার-ও ভয় থাকে না।
(২৯)The Vain Jackdaw
এক ফালতু পাতিকাক-এর গল্প
লোকে বলে, দেবরাজ ইন্দ্র যখন ঠিক করে ফেললেন যে পাখীদের জন্য রাজ্য গড়ে দেবেন, তিনি ঘোষণা দিয়ে দিলেন যে এক নির্দিষ্ট দিনে সব পাখীরা তাঁর সামনে এসে জড় হলে তিনি তাদের মধ্যে থেকে সবচাইতে যাকে সুন্দর দেখতে তাকেই পাখীদের রাজা বেছে নেবেন। এ কথা শুনে এক পাতিকাক, সে তো ভালমতই জানে কি কুচ্ছিৎ দেখতে তাকে, মাঠে-ঘাটে-বনে-বাদাড়ে ঘুরে ঘুরে নানা পাখীদের গা থেকে খসা রকমারী সব পালক যোগাড় করে আনল। এরপর ঐ পালকগুলো নিজের সারা গায়ে গুঁজে নিয়ে খুব বাহার দিয়ে নির্দিষ্ট দিনে আর সব পাখীদের সাথে দেবরাজের সামনে হাজির হয়ে গেল। পাতিকাক-এর চেহারায় মুগ্ধ হয়ে দেবরাজ যেই প্রস্তাব রেখেছেন যে তাকে রাজা হিসেবে বেছে নেওয়া হোক, পাতিকাকের জোচ্চুড়িতে সমস্ত পাখীরা ভীষণ রেগে গিয়ে বিস্তর চ্যাঁচামেচি জুড়ে দিল। আর সেই সাথে, প্রত্যেক পাখী পাতিকাক-এর গা থেকে নিজের নিজের পালক খুবলে খুবলে বার করে নিল। পাতিকাক তখন আবার এক মামুলি পাতিকাক হয়ে গেল।
প্রাচীন বচনঃ ধার করা সাজ-সজ্জায় কাজ হাসিল করতে পারার আশা না করাই ভাল।
আমি বলিঃ সমাজের দায়িত্বশীলরা যখন ঠাট-বাটকে মান্যতার মাপকাঠি করে ফোঁপরা বাহারী মানুষকে মাথায় বসান, তার মোকাবিলা করতে করতে ভুক্তভোগীদের আর অশান্তির শেষ থাকে না, মাথায় চড়া লোকটার-ও দুদিনেই আসল রূপ বেড়িয়ে পরে, কাজের কাজ পুরোই পন্ড।
(৩০)The Milkmaid and her Pot of Milk
গোয়ালিনী আর তার মাথার দুধের বালতি
এক গোয়ালিনী মাথায় দুধের কলসী নিয়ে দুধ বেচতে চলেছে। চলতে চলতে মনটা তার খুশী খুশী হয়ে উঠেছে। “এই দুধ বেচে যা টাকা পাবো তাতে অন্তত তিনশ’ ডিম কিনে ফেলা যাবে। সেই ডিম দিয়ে মুরগীর চাষ শুরু করলে কিছু নষ্ট হলেও কম করে আড়াইশো মুরগীর ছানা পাওয়া যাবে। মুরগীর দাম যখন সবচেয়ে চড়ে উঠবে, এই মুরগীগুলো তখন বেচার জন্য তৈরী হয়ে গেছে। বছর শেষে যা টাকা হাতে জমবে তা দিয়ে একটা নুতন পোষাক কিনে ফেলব। সেটা পরে যখন আমি ক্রিসমাস-এর উৎসবে হাজির হবো, সব ছেলেগুলো আমায় পেতে চাইবে। কিন্তু আমি রাজী হচ্ছি না, পরিস্কার মাথা নেড়ে সব্বাইকে না করে দেব।” ভাবতে ভাবতে তার মাথাটা ভাবনার তালে তালে নড়ে গেল। ফলে মাথা থেকে দুধের কলসী মাটিতে পড়ে ভেঙ্গে শত টুকরো হল, আর সেই সাথে অমন চমৎকার পরিকল্পনাগুলোও এক মুহুর্তে সব শেষ।
প্রাচীন বচনঃ ডিম ফোটার আগেই মুরগীর ছানার হিসেব করতে নেই।
আমি বলিঃ ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার সময় এখন কি করছি সেটা ভুললে চলে না।

মঙ্গলবার, ২৮ মে, ২০১৯

3rd post of my new blog

3rd post of my new blog

 আমি হাজির হয়েছি আবারও ইংরেজি শিখবেন ১০০% তাও আবার অ্যাপ দিয়েএর দ্বিতীয় পর্ব নিয়ে। আমি প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছি নতুন কিছু উদঘাটন করতে যাতে সবার ইংরেজি শেখাটা আরও সহজ করতে পারি। হ্যাঁ অবশ্যই তা সবার সাথে শেয়ার করতে চাই।
যারা প্রথম পোস্টটি দেখেননি তারা এখানে ক্লিক করুন
তাহলে শুরু করার যাক। ধরে নিলাম এমুহূর্তে আপনার মাথায় ৩০০০+ শব্দের একটি ভান্ডার আছে। আচ্ছা ৩০০০ হাজার নাই? ২০০০ হাজার আছে? তাও নাই? ১০০০ হাজার তো আছে?
এখন আমাদের যা করতে হবে তা হচ্ছে Vocabulary স্টক করা। আমাদের যার যত বেশি Vocabulary স্টক থাকবে ইংরেজিতে তার আধিপত্য ততই বেশি হবে। তাই আজকে শেয়ার করবো একটি Vocabulary শিখার অ্যাপ।

অ্যাপটির নাম Vocabulary Builder
এটি তিনটি ক্যাটাগরি দিয়ে সাজানো হয়েছে
যথাক্রমে ☞Beginner ☞IntermediateAdvance
আমরা প্রথমে Beginner দিয়ে শুরু করবো। যারা অল্প ইংরেজি জানেন তাদের জন্য ভালো কারণ এই অ্যাপে Word Meaning গুলো ইংলিশে অর্থাৎ এখানে শব্দের অর্থ গুলো ইংরেজিতে। জানি অনেকেই ইংরেজি বুঝবেন না বা বুঝতে সমস্যা হবে। বুঝেন বা না বুঝেন অর্থ গুলো বুঝার চেষ্টা করুন। না বুঝলেও সমস্যা নেই শব্দটি কপি করে Bangla Dictionary তে পেস্ট করে তার অর্থ জানার চেষ্টা করুন। মনে রাখবেন অর্থ জানার পাশাপাশি আরো অনেক সমার্থক শব্দও শিখতে পারবেন। এভাবেই তো মানুষ শিখে।Bangla Dictionary ডাউনলোড করা না থাকলে ডাইনলোড কর নিন এখানে ক্লিক করুন
অ্যাপটির ডাইনলোড লিংক এখানে ক্লিক করুন
সুবিধা সমূহ – শব্দের ইংরেজি অর্থ, শব্দ Search সুবিধা, ছবি সহ উদাহরণ (ইন্টারনেট সংযোগ প্রয়োজন), শব্দের প্রনালী, শব্দের উচ্চারণ এবং পছন্দে যুক্ত করা সহ ইত্যাদি।

হতাশ হবেন না আমরা এখনও খুব বেসিক লেভেলে আছি। সামনে হয়তো আরো মানসম্মত পর্ব নিয়ে হাজির হব।

চলবে…


কেমন লাগলো জানান কমেন্ট বাক্সে, আপনাদের মতামতের ভিত্তিতে নির্ভর করছে আগামীর পোস্ট।
আমি এসএন জিকু (SN Jiku) আজকের মতো বিদায় নিচ্ছি দেখা হবে পরবর্তী পোস্টে।
ভুল হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
এই গরীবের বন্ধু হোন মুখবুকে Be my friend on Facebook
আর মন চাইলে দর্শন করে সাবস্ক্রাইব করতে পারেন আমার আপনি-নল চ্যানেলটি। YouTube Channel
2nd post of my new blog

2nd post of my new blog

     
ক্যাপশন যোগ করুন




 hfjs is DJs IG. He ukdw jls ud juksvfe e bjd .sbhe eeg




Gd HHS
 die he rdjgdwt he ehhue d dkd ujs gf difd

FD da did.  ff sndjfd fjf
G hgfs yd dvjs eddksddnkd d HD JD d JD a ddxkd db. Jgddbd. Djd ff s gd f f dd sxks dk djg d xgjd c fks SNF d

 hfjs is DJs IG. He ukdw jls ud juksvfe e bjd .sbhe eeg


Gd HHS die he rdjgdwt he ehhue d dkd ujs gf difd

FD da did.  ff sndjfd fjf
G hgfs yd dvjs eddksddnkd d HD JD d JD a ddxkd db. Jgddbd. Djd ff s gd f f dd sxks dk djg d xgjd c fks SNF d
Bgs d HD fs if fnd JD f HD djvdhfd gjf gd HD gd gf ud ff djd hdmgf g ff d gfgne HD s d djjd hj. GS JD g DG fdfd DJ fff jdjf djgbgj jje gf df. F djd df dfddbff JD djdd 
F hgjgbfhif d
 hfjs is DJs IG. He ukdw jls ud juksvfe e bjd .sbhe eeg


Gd HHS die he rdjgdwt he ehhue d dkd ujs gf difd

FD da did.  ff sndjfd fjf
G hgfs yd dvjs eddksddnkd d HD JD d JD a ddxkd db. Jgddbd. Djd ff s gd f f dd sxks dk djg d xgjd c fks SNF d
D u hbf
D d d

সোমবার, ২৭ মে, ২০১৯